এস কে সিনহার বিবৃতির পর যা বলল সুপ্রিম কোর্ট
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার গতকাল শুক্রবারের বিবৃতির পর আজ শনিবার একটি বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। তারা এস কে সিনহার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন, অর্থপাচারসহ ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছে।
আজ শনিবার সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিবৃতির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।
পুরো বিবৃতি নিচে দেওয়া হলো :
ছুটি ভোগরত মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা মহোদয় গত ১৩-১০-২০১৭ ইং তারিখে বিদেশ গমনের প্রাক্কালে একটি লিখিত বিবৃতি উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের নিকট হস্তান্তর করেন। উক্ত লিখিত বিবৃতিটি সুপ্রীম কোর্টের দৃষ্টিগোচর হইয়াছে। উক্ত লিখিত বিবৃতি বিভ্রান্তিমূলক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সুপ্রীম কোর্টের বক্তব্য নিম্নরূপ :
গত ৩০-০৯-২০১৭ইং তারিখে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা মহোদয় ব্যতীত আপিল বিভাগের অন্য পাঁচজন বিচারপতি মহোদয়গণকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানান। মাননীয় বিচারপতি মো. ইমান আলী মহোদয় দেশের বাইরে থাকায় আমন্ত্রণে তিনি উপস্থিত থাকিতে পারেন নাই। অপর চারজন, অর্থাৎ মাননীয় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, মাননীয় বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, মাননীয় বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং মাননীয় বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার মহোদয়গণ মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দীর্ঘ আলোচনার একপর্যায়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা মহোদয়ের বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্বলিত দালিলিক তথ্যাদি হস্তান্তর করেন। তম্মধ্যে বিদেশে অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ আরো সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ রহিয়াছে। ইতোমধ্যে মাননীয় বিচারপতি মো. ইমান আলী মহোদয় ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পর ১ অক্টোবর, ২০১৭ইং তারিখে আপিল বিভাগের উল্লিখিত পাঁচজন বিচারপতি মহোদয় এক বৈঠকে মিলিত হইয়া উক্ত ১১টি অভিযোগ (সংযুক্তিসহ) বিশদভাবে পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ওই সকল গুরুতর অভিযোগসমূহ মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা মহোদয়কে অবহিত করা হইবে। তিনি যদি ওই সকল অভিযোগের ব্যাপারে কোনো সন্তোষজনক জবাব বা সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন, তাহা হইলে তাঁহার সঙ্গে বিচারালয়ে বসিয়া বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হইবে না। এই সিদ্ধান্তের পর ওই দিনই বেলা ১১.৩০ ঘটিকায় মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা মহোদয়ের অনুমতি লইয়া উল্লিখিত পাঁচজন বিচারপতি মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের ১৯ হেয়ার রোড, রমনা, ঢাকার বাসভবনে তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া অভিযোগসমূহ লইয়া বিশদভাবে আলোচনা করেন। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পরেও তাঁহার নিকট হইতে কোনো প্রকার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বা সদুত্তর না পাইয়া আপিল বিভাগের উল্লিখিত মাননীয় পাঁচজন বিচারপতি তাঁহাকে সুস্পষ্টভাবে জানাইয়া দেন যে, ‘এমতাবস্থায়, উক্ত অভিযোগসমূহের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তাঁহার সঙ্গে একই বেঞ্চে বসিয়া তাঁহাদের পক্ষে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হইবে না’। এ পর্যায়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, সে ক্ষেত্রে তিনি পদত্যাগ করিবেন। তবে এই ব্যাপারে পরের দিন অর্থাৎ ০২-১০-২০১৭ইং তারিখে তিনি তাঁহার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাইবেন। অতঃপর ০২/১০/২০১৭ইং তারিখে তিনি উল্লিখিত মাননীয় বিচারপতিগণকে কোনো কিছু অবহিত না করিয়াই মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট ১ (এক) মাসের ছুটির দরখাস্ত প্রদান করিলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেন। তৎপ্রেক্ষিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি, মাননীয় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির অনুরূপ কার্যভার পালনে দায়িত্ব প্রদান করেন।
উল্লেখ্য, প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সেই পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে ইতোপূর্বে সুপ্রিম কোর্টের তরফ হইতে কোনো প্রকার বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান করা হয় নাই। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নির্দেশক্রমে উপরি-উক্ত বিবৃতি প্রদান করা হইল।
তারিখ : ১৪-১০-২০১৭ ইং (সৈয়দ আমিনুল ইসলাম)
রেজিস্ট্রার জেনারেল
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
এর আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গতকাল শুক্রবার রাত ১১টা ৫৫টা মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে করে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে রওনা হন। রাজধানীর হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবন থেকে বের হওয়ার সময় সেখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, যথাসময়ে তিনি দেশে ফিরে আসবেন। একপর্যায়ে কাগজে লেখা একটি বিবৃতি দিয়ে দেন।
বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি, কিন্তু ইদানীং একটি রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারের একটা মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শঙ্কিতও বটে। কারণ গতকাল প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধুমাত্র রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।’
এর আগে প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব ও অতিরিক্ত জেলা জজ মো. আনিসুর রহমান জানান, প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর মেয়ে সূচনা সিনহার কাছে থাকবেন।
গত ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিদেশে অবস্থানের জন্য অনুমতি চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করে একটি চিঠি দেন। এতে তিনি ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরে থাকার কথা উল্লেখ করেন।