পেটে গজ রেখেই সেলাই, চিকিৎসক ফিরিয়ে দেন বারবার!

পাপিয়া বেগম (২৬) দ্বিতীয় সন্তানের মা হয়েছেন ১২ সেপ্টেম্বর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক ডা. নাজমা হকের তত্ত্বাবধানে ডা. সালমা চৌধুরী অন্তঃসত্ত্বা পাপিয়ার সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করেন। একটি ছেলেসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। জন্মের পরে সন্তান সুস্থ থাকলেও অসুস্থ হয়ে পড়েন পাপিয়া। কিন্তু অস্ত্রোপচারের মাত্র দুদিন পরই তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ফলে অসুস্থতা নিয়েই তাঁকে বাড়ি চলে যেতে হয়।
পাপিয়ার স্বামী আবদুল লতিফ নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। অসুস্থ স্ত্রীকে কেন ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে চিকিৎসকরা দু-তিনদিন পর হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন।
ডা. সালমা চৌধুরী
আবদুল লতিফ জানান, বাধ্য হয়েই গত ১৪ সেপ্টেম্বর পাপিয়াকে বাসায় নিয়ে যান তিনি। কিন্তু পাপিয়ার পেটের ব্যথা প্রচণ্ড বেড়ে যায়। গত ২০ সেপ্টেম্বর পাপিয়াকে আবার ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগে দেখানো হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা বলেন, রোগীর অবস্থা ভালো নয়। গাইনি বিভাগে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, তাঁকে দ্রুত সেই বিভাগে নিয়ে যেতে হবে। পাপিয়াকে সেদিনই ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর তাঁকে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তখনো সুস্থ হননি তিনি। এরপর আবার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য চলতি মাসের ৫ অক্টোবর পাপিয়াকে রাজধানীর গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যান আবদুল লতিফ। সেখানে গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা আহমেদ ন্যান্সি রোগীকে তাঁর পরিচিত মুগদা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, মুগদা মেডিকেলে তিনি নিজেই পাপিয়ার চিকিৎসা করবেন। তখন পাপিয়াকে মুগদা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে নানা রকম পরীক্ষার কথা বলে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন পাপিয়ার স্বামী লতিফ।
পাপিয়ার স্বজনরা বলেন, সর্বশেষ লতিফ তাঁর স্ত্রীকে বাঁচাতে সিদ্ধান্ত নেন ডা. নাজমা হকের কাছেই তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারে পাপিয়াকে দেখাবেন। এরপর তিনি গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. নাজমা হকের চেম্বারে পাপিয়াকে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে তাঁদের দেখে রেগে যান ডা. নাজমা। তিনি গালাগাল দিয়ে রোগী ও তাঁর স্বামীকে তাঁর কক্ষ থেকে বের করে দেন।
জানা যায়, সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনির আরেক চিকিৎসক ডা. জেসমিন আরা বেগমের তত্ত্বাবধানে পাপিয়াকে ১৩ অক্টোবর ভর্তি করা হয়। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে পাপিয়ার পেটে পুনরায় অস্ত্রোপচার করে পেট থেকে একটি বড় আকারের গজ (অস্ত্রোপচারের সময় রক্ত পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার করা হয়) বের করা হয়। সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রায় এক মাস পর চিকিৎসকের ভুলে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন পাপিয়া। এরপর সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে ২০ অক্টোবর পাপিয়াকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
এই অভিযোগ সম্পর্কে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমা হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে প্রচুর রোগী, ভুলক্রমে এটা হয়। এটা কারো ইচ্ছাকৃত হয় না। আমাদের ঢাকা মেডিকেলে এমন অনেক ঘটনা হয়, আমরা এটা কাউকে বা রোগীর লোকদের জানতে দেই না। এটা জানতে পারলে রোগীও মন খারাপ করে। বাইরে থেকে অস্ত্রোপচার করে এলে আমরা এরকম অনেক মপ (পরিষ্কার করার গজ) পাই। কিন্তু সেটা আমরা লিখিত রাখি না।’
গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমা হক
ডা. নাজমা আরো বলেন, ‘এ সিজার আমি করি নাই, করেছেন ডা. সালমা চৌধুরী। কিন্তু রোগীর পেটে এটা স্বাভাবিকভাবে রাখার কথা না, তারপরও যদি ভুলক্রমে রেখে থাকে তবে এই দায়ভার তাঁকেই নিতে হবে।’ এই সম্পর্কে জানতে ডা. সালমা চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে, পাপিয়া ও তাঁর স্বজনরা বলেন, ডা. নাজমার অধীনেই অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিনি সব জানেন। তিনি অস্ত্রোপচারের দুদিন পর পাপিয়াকে ছাড়পত্র দিয়েছিলেন।
পুরো ঘটনা জানার পরে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়। হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মুনছুর আলী ও ডা. এ কে এম মোজাহার হোসেন বিষয়টি নিয়ে গতকাল রোববার বিকেল থেকেই তদন্ত শুরু করেন।
ডা. মুনছুর আলী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এমন অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয় তবে ওই ডাক্তারদের এই হাসপাতালে আর বসতে দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের আরেক উপপরিচালক ডা. এ কে এম মোজাহার হোসেন গতকাল রাত ১০টার দিকে জানান, তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। এই চিকিৎসকদের হাসপাতালে আর বসতে দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে রোগীর এই করুণ ঘটনা শুনে হাসপাতালের মূল খরচের ৫০ শতাংশ টাকা ছাড় দেয় কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসকদের বিল হয়েছিল সেখান থেকেও ২০ হাজার টাকা কম করা হয়।