চোখ হারানোর আগেই পুলিশের সঙ্গে ছিল শাহজালাল!

পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পর চোখ হারান সবজি ব্যবসায়ী মো. শাহজালাল। এটা শাহজালালের স্বজনদের দাবি। পুলিশের দাবি, ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনিতে চোখ হারিয়েছেন শাহজালাল। ঘটনার পর থেকেই শাহজালালের দাবি ছিল, খুলনার খালিশপুর থানার ফুটেজ পরীক্ষা করা হোক।
খালিশপুর থানার দাবি, ফুটেজে শাহজালাল নেই। এদিকে খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) দাবি, ঘটনার দিন সিসিটিভি ক্যামেরা নষ্ট ছিল।
ওই মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত সূত্রে জানা যায়, খালিশপুরের একটি ক্লিনিকে ফুটেজ পিবিআইয়ের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যায়, পুলিশই শাহজালালকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওই ক্লিনিকে নিয়ে আসে। তখনো শাহজালালের চোখ উপড়ে ফেলা হয়নি। চিকিৎসা শেষে পুলিশই শাহজালালকে নিয়ে বের হয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্রের মাধ্যমে এ তথ্য জানা যায়। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলতে চাইছে না পিবিআই।
গত ১৮ জুলাই শাহজালালের দুই চোখ উপড়ে ফেলা হয়। তিনি এখন চোখে দেখেন না।
খালিশপুর থানা এলাকার গোয়ালখালীতে ওই ঘটনা ঘটে। শাহজালাল ও তাঁর স্বজনদের দাবি, ঘটনার দিন সাদা পোশাকে খালিশপুর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাসেলসহ দুজন রাত ৮টার হঠাৎ তাঁকে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে আটক করে ‘যুবলীগের অফিসে’ (যাত্রীছাউনিতে ছাত্রলীগ/যুবলীগ নেতারা বসেন। তাই যুবলীগ অফিস হিসাবে পরিচিত) নিয়ে রাখে। পরে পুলিশের গাড়ি এসে শাহজালালকে খালিশপুর থানা হাজতে নিয়ে যায়। এই সময় এএসআই রাসেল ও সোর্স রাসেল দুই লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে থানা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে শাহজালালকে দুই চোখ হারানো অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাওয়া যায়।
পুলিশের দাবি, ঘটনার দিন রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েন শাহজালাল এবং পরে গণপিটুনির পর তাঁর দুটি চোখ তুলে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে সেদিন রাতেই সুমা আক্তার বাদী হয়ে দুজনকে আসামি করে ছিনতাই মামলা দায়ের করেন। এরই মধ্যে শুধু শাহজালালকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, খালিশপুর থানার হাজত, প্রবেশ-বহির্নিগমন পথ সব সিসিটিভি ক্যামেরায় আওতাধীন। শাহজালালের দাবি, তাঁকে সুস্থ অবস্থায় থানাহাজতে রাখা হয়েছিল অন্য আসামিদের সঙ্গে। যা সিসি ক্যামেরায় খোঁজ করলে পাওয়া যাবে।
ফুটেজ নিয়ে দুই রকম তথ্য
সিসিটিভি ক্যামেরায় গত ১৮ জুলাই রাতের ফুটেজে শাহজালালকে দেখা গেছে কি না জানতে চাইলে খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসিম খান জানান, তাঁরা ১৮ জুলাই রাতের ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখেছেন। এতে শাহজালালের কোনো ফুটেজ নেই। তিনি আরো জানান, বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখেছেন কেএমপির তদন্ত কমিটি। এই সময় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য ভিন্ন বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি আবার বক্তব্য পরিবর্তন করেন। তিনি বলেন, ‘ডিসি স্যার ভালো জানেন। কারণ ওনারা তদন্ত করে দেখেছেন।’
এ ব্যাপারে কেএমপির ডেপুটি কমিশনার (উত্তর) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, গত ১৮ জুলাই ঘটনার সময় সিসিটিভি ক্যামেরা খারাপ ছিল। ফলে ওই সময়ের কোনো ফুটেজ নেই। ফলে শাহজালাল থানায় গিয়েছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘যেহেতু মামলাটি বিচারাধীন, তাই কিছু বলা যাবে না।’
পিবিআই সূত্রে জানা যায়, খালিশপুর ক্লিনিকের সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে, শাহজালালকে নিয়ে আসা হয় প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য।
এ ব্যাপারে খালিশপুর ক্লিনিকের স্বত্বাধিকারী ডা. মুজাহিদুল ইসলাম জানান, তিনি কর্তব্যরত চিকিৎসকের কাছে শুনেছেন, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টার পর পুলিশ একজন আসামিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ক্লিনিকে নিয়ে আসে। চিকিৎসার পর তাঁকে আবার পুলিশ নিয়ে যায়। তবে ওই সময় ওই রোগীর নাম ‘অ্যান্ট্রি’ করা হয়নি। তিনি আরো জানান, তদন্তকারী দল ক্লিনিকের সেই ফুটেজও নিয়ে গিয়েছে।
মুজাহিদুল ইসলাম জানান, পরে তিনি জেনেছেন চোখ ওঠানো সেই শাহজালালকেই রাতে এই ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে পিবিআইয়ের খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান জানান, তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কোনো কিছু বলা যাবে না। তিনি জানান, আদালত আগামী ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে ।
অভিযুক্তদের বদলি না করায় হতাশা
শাহজালালের মা রেনু বেগম গত ৭ সেপ্টেম্বর আদালতে মামলা দায়ের করেন। খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খানসহ ১৩ জনকে আসামি করে তিনি মামলা করেন। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য খুলনা পিবিআইকে নির্দেশ দেন। গত ১৮ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। ১৮ তারিখে পিবিআই আরো সময়ের আবেদন করলে আগামী ২৬ ডিসেম্বর পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী মোমিনুল ইসলাম বলেন, শাহজালালের বিরুদ্ধে দায়ের করা ছিনতাই মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। তিনি অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের থানার দায়িত্ব থেকে বদলি না করায় হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি দাবি করেন, খালিশপুর থানার ওসিকে বদলি না করলে মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত হবে না।
পুলিশের সোর্স এবং শাহজালালের মা রেনু বেগমের দায়ের করা মামলার আসামি রাসেলের বাবা লুৎফর রহমান জানান, খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খান ও এএসআই রাসেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে, কেন তাঁরা চোখ উঠাল? তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘পুলিশ সব জানে। আর সেই পুলিশ কর্মকর্তাদের কেন এখনো বদলি করা হয়নি তা রহস্যজনক।’
এদিকে শাহজালালের বিরুদ্ধে দায়ের করা ছিনতাইয়ের অভিযোগে মামলা করেন সুমা আক্তার। গত ১৮ অক্টোবর খুলনা প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ওই ছিনতাইয়ের সঙ্গে শাহজালাল জড়িত।