সরকারি ড্রেজার ব্যবহার করে ভাড়া না দেওয়ার অভিযোগ

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রায় ৪০ কোটি টাকা দামের দুটি ড্রেজার ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে।
যাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তিনি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান। তাঁর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মেসার্স হাওলাদার কনস্ট্রাকশন এক বছর ধরে ব্যবহার করছে ড্রেজার দুটি। এমনকি রং করে বদলে ফেলা হয়েছে ড্রেজার দুটির চেহারা। ফলে এলাকাবাসীও জানেন মেসার্স হাওলাদার কনস্ট্রাকশনই কিনেছে যন্ত্র দুটি।
তবে মেহেদী হাসানের বাবা আওয়ামী লীগ নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান জানান, ড্রেজার দুটি এনে মেরামত বাবদ তাঁদের প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজার বিভাগ খুলনার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুস সালাম খান জানান, গত বছরের ১৬ অক্টোবর ঢাকার দক্ষিণ মুগদাপাড়ার ঠিকানা ব্যবহার করে মেসার্স হাওলাদার কনস্ট্রাকশনের মালিক মেহেদী হাসান পাউবোর মহাপরিচালক বরাবরে একটি আবেদন করেন। আবেদনের বিষয় ছিল ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড অধীনস্থ ড্রেজার পরিদপ্তর, খুলনা ড্রেজার বেইজ এস ডি কপোতাক্ষ ১৮ ইঞ্চি ও এস ডি ভদ্রা ১২ ইঞ্জি ডায়া কাটার সাকশন ড্রেজার দুটি আমার নামীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে লিজ/ভাড়া প্রদানকরণ প্রসঙ্গে’।
আবেদনপত্রে গোপালগঞ্জ জেলাধীন কোটালীপাড়া থানার ঘাঘর নদী খনন কাজসহ বর্তমানে মেসার্স হাওলাদার কনস্ট্রাকশনের নামে একাধিক ড্রেজিং কাজ চলমান আছে বলে জানানো হয়। এ ছাড়া আরো কয়েকটি ড্রেজিং কাজের জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠান চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বলেও আবেদনে জানান মেহেদী হাসান। তাই সরকারি নিয়ম কানুন মেনেই তিনি ড্রেজার দুটি লিজ/ভাড়া নিতে আগ্রহী বলে আবেদনে উল্লেখ করেন। ড্রেজার দুটি নিজস্ব অর্থায়নে সচল করে নেবেন বলেও সেখানে জানানো হয়।
তবে এই আবেদনের পর কোনো চুক্তিপত্র ছাড়াই ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ড্রেজার পরিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কে এম নুরুল ইসলাম এক দপ্তরাদেশে ড্রেজার দুটি হাওলাদার কনস্টাকশনকে সব মালামালসহ অবিলম্বে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন।
এই দপ্তরা দেশে খুলনা ড্রেজার বেইসে রাখা এস ডি কপোতাক্ষ এবং এস টি ভদ্রা দুটি হাউজবোট, ফ্লোটিং পাইপ, সোর পাইপ ও আনুষঙ্গিক মালামালসহ বাৎসরিক ভাড়া ভিত্তিতে মেসার্স হাওলাদার কনস্ট্রাকশনকে দিতে বলা হয়। এরপর হাওলাদার কনস্ট্রাকশন একই বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ড্রেজার দুটি খুলনা থেকে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় নিয়ে যায়।
ড্রেজার দুটি নেওয়ার পর এর ভাড়া পরিশোধ বা চুক্তিপত্র করার জন্য খুলনা ড্রেজার বিভাগ থেকে বার বার চিঠি দেওয়া হয়। গত বছরের ২৮ জুন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুস সালাম খান স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়, ‘চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের জন্য বারং বার অনুরোধ করা হইয়াছে। কিন্তু আপনি অদ্যবধি চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেন নাই।’ একই সঙ্গে সেখানে প্রথম কিস্তির টাকা পরিশোধেরও অনুরোধ করা হয়।
পাউবোর ড্রেজার বিভাগের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী শামসুদ্দিন আহমেদ জানান, তিনি যোগদান করে ড্রেজার গ্রহণের ১০ মাস পর অনেক কৌশল করে গত ১ আগস্ট হাওলাদার কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে দুটি ড্রেজার ভাড়ার চুক্তি করেন। পর্যায়ক্রমে ভাড়া আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
চুক্তিতে এস ডি কপোতাক্ষ বছরে (ভ্যাট সহ) দদুই কোটি ৭৯ লাখ ৮২ হাজার ৮০ টাকা ,পাইপ ভাড়া ৬৪ হাজার ৫১২ টাকা এবং এস ডি ভদ্রা বাবদ ৭৯ লাখ ২৮ হাজার ২৫৬ টাকা ও পাইপ ভাড়া ৬২ হাজার ৫১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
চুক্তিপত্রে ১৪ নম্বর ধারায় বলা হয় যে, চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের সাতদিনের মধ্যে ড্রেজার সচল করতে হবে এবং চুক্তির অষ্টম দিন থেকে ভাড়া কার্যকর হবে।
তবে বাস্তবে চুক্তিপত্র সম্পাদনের প্রায় ১০ মাস আগেই ড্রেজার হস্তান্তর করা হয় এবং ড্রেজার ভাড়া নেওয়ার এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজার বিভাগে কোনো ভাড়ার টাকা জমা হয়নি।
চুক্তিপত্র অনুযায়ী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়োজিত কর্মীরা ড্রেজার পরিচালনা করবে এবং তাঁদের বেতনসহ অন্যান্য ভাতা ভাড়া নেওয়া প্রতিষ্ঠান বহন করবে। কিন্তু ড্রেজারটিতে পাউবোর কোনো কর্মী নেই। তার বদলে সেটি পরিচালনা করছে লিজ নেওয়া প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা।
এদিকে লিজ নেওয়া প্রতিষ্ঠান পাউবো থেকে কর্মী না নেওয়ায় ড্রেজার দুটির জন্য নির্ধারিত দুই কর্মীকে অলস বসে থাকতে হচ্ছে খুলনা কার্যালয়ে। ফলে তাঁদের বেতন ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে পাউবোকেই। এতে বছরে পাউবোর খরচ হচ্ছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।
চুক্তিপত্রের ৪ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে ড্রেজার সচল/অচল/মেরামতাধীন যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন ত্রৈমাসিক হিসাবে প্রতি তিন মাস পর পর ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। সেই হিসেবে ড্রেজার দুটি নেওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পরিশোধ করা হয়নি ভাড়ার একটি টাকাও।
গত বছরের এক আগস্ট হওয়া এই চুক্তিপত্রে খুলনা ড্রেজার বিভাগের পক্ষে প্রথম পক্ষ হিসেবে স্বাক্ষর করেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুস সালাম খান এবং সাক্ষী হিসেবে ছিলেন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. গোলাম নবী ও খান মো. আব্দুস সালাম।
অন্যদিকে হাওলাদার কনস্ট্রাকশনের মালিক মেহেদী হাসানের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে ছিলেন তাঁর বাবা কোটালী পাড়া উপজেলার চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার এবং ক্ষিতীশ দত্ত নামের এক ব্যক্তি।
ড্রেজার বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুস সালাম খান জানান, তাঁরা অনেক চেষ্টার পর চুক্তিপত্র করেছেন। পুরো বিষয়টি প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তর নিয়ন্ত্রণ করছে বলেও জানান তিনি ।
গত মাসের শেষ সপ্তাহে গোপলগঞ্জ কোটালীপাড়ার ঘাঘর নদীতে এস ডি কপোতাক্ষ ড্রেজারটি নোঙ্গর করা অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। তখন সেখানে হাওলাদার কনস্ট্রাকশনের কর্মীরা মেরামতের কাজ করছিলেন। এ ছাড়া এস ডি ভদ্রা ঘাঘর নদীতে ড্রেজিং কাজে নিয়োজিত ছিল।
ড্রেজার বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. গোলাম নবী জানান, উল্লেখিত ড্রেজার দুটি কেজিডিআরপি প্রকল্পের আওতায় ভবদহ নদ খনন কাজের জন্য প্রথম আনা হয়েছিল। সেই কাজ শেষ করার পর তাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ড্রেজার দুটির বাজার মূল্য ৪০ কোটির টাকার বেশি বলেও জানান তিনি।
চুক্তিপত্র অনুযায়ী ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে উল্লেখিত সময় থেকে এক বছর। সেই হিসাবে ড্রেজার ব্যবহারের সময় সীমা ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসেই শেষ হয়ে গেছে। বিষয়টি প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তর নিয়ন্ত্রণ করছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের কাছে যে নির্দেশনা আসে তাঁরা শুধু সে অনুযায়ীই কাজ করেন।
এ ব্যাপারে কোটালীপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুজিবর রহমান হাওলাদার জানান, ড্রেজার মেরামত করতে তাঁদের তিন কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়ে গেছে। এ ছাড়া ড্রেজার বিভাগের লোকবল ড্রেজারে না থাকায় নিজেদের কর্মী দিয়েই তা পরিচালনা করান তাঁরা।
পাউবোর অনুমতি ছাড়া এত টাকা ব্যয় করলেন কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে এই চেয়ারম্যান বলেন, পরে একটা ব্যবস্থা হবে। গত ১১ মাসে কোনো ভাড়া দেননি বলেও স্বীকার করে নেন তিনি।
হাওলাদার কনস্ট্রাকশনের মালিক মেহেদী হাসান জানান, তিনি সংগঠন চালান, কোনো চাঁদাবাজির ব্যবসা করেন না, তাই নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানোর জন্য ব্যবসা করেন। ২০১৫ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হলেও তার আগে থেকেই ঠিকাদারি করেন বলেও জানান এই নেতা। এ ছাড়া ড্রেজার দুটি গত এক বছরের বেশি সময় তাঁদের কাছে থাকলেও বেশি লাভবান হতে পারেননি বলেও জানান তিনি।
তবে দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজার লিজ নিয়ে রাখা এবং এর ভাড়া পরিশোধ সম্পর্কে কিছু বলেননি মেহেদী হাসান।