দুই নারীর সঙ্গে বর্বরতা, হুমকির মুখে বাড়ি ছাড়া

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলায় ‘কথিত’ সমাজপতিদের হাতে নির্যাতিত গৃহবধূ সুলতানাকে (ছদ্মনাম) ক্রমাগত হুমকি দেওয়া হচ্ছে। মামলার এক আসামি তিনদিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে এসে এ হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। এ কারণে তিনি স্বামীর বাড়ি ফিরতে পারছেন না।
একই ঘটনার শিকার সুলতানার খালাতো বোন পারভীন খাতুন (ছদ্মনাম) ও আরিফুর রহমানও (ছদ্মনাম) এখন বাড়ি ছেড়ে লুকিয়ে রয়েছেন।
অপরদিকে গত ২৯ আগস্ট উপজেলার কেড়াগাছি ইউনিয়নের পাঁচপোতা গ্রামে সংঘটিত এ ঘটনায় দায়ের মামলার আসামি আবদুল কুদ্দুস গ্রেপ্তারের তিনদিনের মাথায় জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। অন্য আসামিদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
প্রবাসীর স্ত্রী সুলতানা গত ২৯ আগস্ট তাঁর স্বামীর বাড়িতে খালাতো বোন ও বোনের স্বামীর সঙ্গে গল্প করছিলেন। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে একদল ব্যক্তি। নিজেদের ‘সমাজপতি’ দাবি করে প্রবাসীর স্ত্রীর খালাতো বোন ও বোনের স্বামীকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। একপর্যায়ে ওই দম্পতির বিয়ের কাগজপত্র দেখতে চায়। ওই অজুহাত দিয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ আনে তথাকথিত ‘সমাজপতি’রা।
কেবল অভিযোগ এনেই ক্ষান্ত হয়নি ‘সমাজপতি’রা। তিনজনকে প্রকাশ্যে গ্রামের সবার সামনে রশি দিয়ে বেঁধে পিটিয়েছে। কানে ধরে উঠবস করিয়েছে। ১২ দিন আগে এ ঘটনা ঘটলেও সুলতানা ও তাঁর স্বজনরা বিষয়টি কাউকে জানায়নি। কিন্তু সম্প্রতি ওই নির্যাতনের ছবি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
সুলতানা সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় ১২ বছর আগে একই উপজেলার কেড়াগাছি ইউনিয়নের পাঁচপোতা গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহিমের (ছদ্মনাম) সঙ্গে সুলতানার বিয়ে হয়। রহিম তিন বছর ধরে মালয়েশিয়ায় চাকরি করছেন। তাঁর একটি মেয়ে রয়েছে।
আজ শনিবার সুলতানার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে গিয়ে দেখা যায় থমথমে ভাব। এ মামলার মূল আসামি ট্রলিচালক বিল্লাল হোসেন, মোস্তফা, ইসমাইল হোসেনসহ ঘটনার মূল নায়করা এলাকা ছেড়েছেন। কুদ্দুস বাড়ি ফিরলেও সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে গা ঢাকা দেন।
বিচার চান সুলতানার বাবা-মা
সুলতানা এখন তাঁর বাবার বাড়ি রামকৃষ্ণপুর গ্রামে রয়েছেন। তাঁর বাবা বলেন, ‘নারী নির্যাতনের এ দৃশ্য ভয়াবহ। আমার মেয়ের হাড় ভেঙে দিয়েছে। কান ধরে উঠবস করিয়ে অমানবিক আচরণ করেছে। কোমরে রশি বেঁধে তাঁকে সামাজিকভাবে অপমান করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের প্রত্যেকের সাজা হোক।’
সুলতানার মা বলেন, ‘আমার মেয়ে ভালো। ছোট বয়সে ওরে বিয়ে দিয়েছি। তখন সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। ১২ বছরের মধ্যে আমার মেয়ে সম্পর্কে কেউ কোনোদিন কোনো খারাপ কথা বলেনি। এখন তাঁকে দিন-দুপুরে মারধর ও কান ধরে উঠবস করিয়ে শ্বশুরবাড়ির এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে সমাজপতিরা। আমি এর বিচার চাই। আমার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাক এবং সেখানে নিরাপদে ও শান্তিতে থাকুক।’
‘পুলিশ খালি টাকা চায়’
সুলতানার মা অভিযোগ করে বলেন, মেয়ের নির্যাতনের ঘটনায় মামলা করতে গেলে কলারোয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোয়াজ্জেম তাদেরকে লকআপে ঢুকিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তিনি আমার মেয়েকে নোংরা ভাষায় কথা বলে আক্রমণ করেন।
মামলার দিন এসআই তিন হাজার টাকা নিয়েছিলেন দাবি করে সুলতানার মা বলেন, এসআই শনিবার (আজ) সুলতানাকে আরো ১০ হাজার টাকা নিয়ে থানায় যেতে বলেছেন । না হলে মামলা দুর্বল হয়ে থাকবে বলে হুমকি দেন।
সুলতানাও একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘মামলাটি হয়েছে ঘটনার কয়েকদিন পরে। অবহেলামূলক আচরণের কথা তুলে এসআই মোয়াজ্জেম শুধু টাকা চান।’ সুলতানার প্রশ্ন, নারী নির্যাতনের মতো এত বড় মামলার আসামি কুদ্দুস তিনদিনেই কীভাবে জামিন পান?
এগুলি অপপ্রচার : এসআই
সুলতানা ও তাঁর মায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এসআই মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এগুলি অপপ্রচার। বরং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সালেহ মাসুদ করিমের নির্দেশেই আমি মামলাটি দায়ের করাই। সুলতানা মামলা দিতে রাজিই হচ্ছিলেন না।’
ওসি আবু সালেহ মাসুদ করিম বলেন, ‘আমি খবর পেয়ে মেয়েটিকে ডেকে এনে থানায় মামলা করাই। তিনি ২০ জনের নাম বললেই সবাই যে আসামি হবেন তা ঠিক নয়। কারণ ঘটনা ঘটিয়েছে কয়েকজন, অন্যরা ছিলেন দর্শকমাত্র।’
পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ থাকলে তা তদন্ত করে দেখবেন বলে জানান ওসি। এ ছাড়া মেয়েটির নিরাপত্তার ব্যাপারে পুলিশ সব ধরনের সহযোগিতা করবে বলেও জানান তিনি।
‘ফারুক মেম্বার ওদের ধরে আনতে বলে’
পাঁচপোতা গ্রামের পুলিশিং কমিটির কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে নিয়েই দ্বিতীয় দফায় নির্যাতন করা হয় সুলতানা, তাঁর খালাতো বোন ও ভগ্নিপতির ওপর।
ইসমাইলের স্ত্রী রাশিদা খাতুন আজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কোনো দোষ নেই। আমাদের বাড়িতে ওদের নিয়ে এসে মারধর করে এ কথা সত্য। কিন্তু আমার স্বামী সেদিন বাড়ি ছিলেন না।’
‘আমরা সবাই এর বিরুদ্ধে কথা বললেও কুদ্দুস, মোস্তফা, বিল্লাল ও তাদের সাগরেদরা তা কানে তোলেনি। সেদিন আমাদের বাড়িতে কেড়াগাছি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফারুক মেম্বার এসেছিলেন। তিনিই ওদেরকে এখানে আনতে বলেন।’ যোগ করেন ইসমাইলের স্ত্রী।
সুলতানার মেজো ভাসুর মজিদুল বলেন, ‘বিল্লাল, মোস্তফা, কুদ্দুসসহ বেশ কয়েকজন দিন-দুপুরে এসে এ ঘটনা ঘটায়। তারা সুলতানাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তখন তাঁকে ফারুক মেম্বারের কাছে নিয়ে যাই এবং বলি, আপনি যা বিচার করেন তাই মেনে নেব।’
আমি ভিন্ন গ্রামে ছিলাম : ফারুক মেম্বার
ইউপি সদস্য ফারুক হাসেন বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ভিন্ন গ্রামে ছিলাম। কলারোয়া থানার একজন এসআই আমাকে ফোন করে এসব বিষয় জানালে আমি ফিরে আসি। ততক্ষণে তিনজনকে কান ধরে উঠবস করানো হচ্ছে দেখে আমি তা বন্ধ করে দেই। তাদের বাঁধন খুলে দেই ও লাঠি কেড়ে নেই। পরে সুলতানার খালাতো বোন ও ভগ্নিপতিকে তাদের এলাকার ইউপি সদস্য হাসিনা খাতুন ও আবুল হাসানের হাতে তুলে দেই।’
ফারুক মেম্বার ভালো মানুষ : ইউপি চেয়ারম্যান
সাংবাদিকদের কাছে পাঁচপোতা গ্রামের অনেকে অভিযোগ করেন, এ ঘটনার ফারুক মেম্বার সব কিছুই জানেন এবং তিনিই সব কিছু ঘটিয়েছেন। তবে কেড়াগাছি ইউপির চেয়ারম্যান ভুট্টো লাল গাইন বলেছেন, এটি ফারুকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার।
নির্যাতনের ঘটনাকে জঘন্য অপরাধ উল্লেখ করে ইউপি চেয়ারম্যান এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, সুলতানাকে বিল্লাল নানা ধরনের কুপ্রস্তাব দিত। এতে সাড়া না দেওয়ায় তাঁদের অপবাদ দিয়ে এই ঘৃণ্য অপরাধ করা হয়েছে।
মেম্বার ফারুক আহমেদ সম্পর্কে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘তিনি একজন ভালো মানুষ। ৩০ বছর ধরে ইউপি সদস্য তিনি। অনেকেই মেম্বার হতে চায়। হয়তো এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’