শিক্ষায় ভ্যাট বেআইনি, সংবিধান পরিপন্থী
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/09/13/photo-1442137618.jpg)
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, যেহেতু সংবিধানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং সব নাগরিকের পেশা ও বৃত্তি গ্রহণের জন্য আইনের দ্বারা যোগ্যতা অর্জনের কথা বলা হয়েছে, তাই শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপ অসাংবিধানিক।
এ ছাড়া ভ্যাট আইন অনুযায়ী, বাজারজাত করা যায় শুধু এমন সব পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপের বিধান রয়েছে। যেহেতু শিক্ষা বাজারজাত করার মতো পণ্য নয়, সেহেতু এর ওপর ভ্যাট আরোপ বেআইনি বলেও মত আইন বিশেষজ্ঞদের।
হাইকোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ভ্যাট অ্যাক্ট-১৯৯১ অনুযায়ী, শিক্ষার ওপর ভ্যাট বসানোর কোনো বিধান নেই। ভ্যাট অ্যাক্টের ১৮ ধারায় বলা আছে, আমদানি ও রপ্তানির ওপর ভ্যাট বসাতে পারে; শিক্ষার ওপর কোনো ভ্যাট বসানোর নিয়ম নেই।’
অ্যাডভোকেট শেখ আখতার-উল ইসলাম বলেন, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। সংবিধানের ৩৯ ও ৪০ অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের পেশা ও বৃত্তি গ্রহণের জন্য আইনের দ্বারা যোগ্যতা অর্জনের কথা বলা হয়েছে। সেখানে সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণের সমান সুযোগ সব নাগরিকের রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু বেসরকারি শিক্ষার্থীদের ওপর ভ্যাট আরোপ করা মানুষের মৌলিক অধিকার ও সংবিধান পরিপন্থী।
এই ব্যবস্থা বাতিল করে সবার জন্য সমান শিক্ষা নিশ্চিত না করা গেলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে বলেও আশঙ্কা করেন শেখ আখতার-উল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ভ্যাট অ্যাক্ট-১৯৯১ অনুযায়ী, শুধু যেসব পণ্য বাজারজাত করা যায়, তার ওপর ট্যাক্স বা ভ্যাট আরোপ করা হয়। শিক্ষা কোনো বাজারজাতকৃত পণ্য নয়, সুতরাং এখানে ভ্যাট আরোপ প্রযোজ্য নয়।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রকে সব নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সারা দেশের ছাত্রছাত্রীদের যেহেতু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ সরকার দিতে পারছে না, তাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে সরকারই উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু তারা যখন প্রতিষ্ঠান খুলল, তখন সরকার পণ্যের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভ্যাট আরোপ করল, যা সংবিধান পরিপন্থী। আমি মনে করি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভ্যাট প্রত্যাহার করে সরকারের উচিত ৫০ ভাগ টিউশন ফি দেওয়া। তাহলেই নাগরিকের অধিকার রক্ষা পাবে।’
এদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করছেন দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত বুধবার থেকে শুরু হওয়া এই ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন আজ রোববার পঞ্চম দিনে পড়েছে।
আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সরকার এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে বলা হয়, এই বর্ধিত ভ্যাট শিক্ষার্থীকে নয়, বরং দিতে হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। এমনকি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ্যে ঘোষণাও দেয়, তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভ্যাটের অর্থ আদায় করবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে এই ভ্যাট পরিশোধ করা হবে।
তবে এসব ঘোষণার পরও শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা ছলে-বলে-কৌশলে ভিন্ন উপায় বের করে শেষ পর্যন্ত তাদের কাছ থেকেই আদায় করা হবে এই ভ্যাট। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের উৎসই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের দেওয়া অর্থ। তাই ভ্যাট বাড়লে সেটাও গিয়ে পড়বে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে।
এ ছাড়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষা সব মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকারের ওপর ভ্যাট আরোপ করা রীতিমতো বেআইনি। শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত তৈরি হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ও এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু ব্যবসা করছে, সেহেতু ব্যবসার লাভের অর্থ থেকে সরকারকে রাজস্ব দিতে তারা বাধ্য। অন্যদিকে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের মত, শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপ আইনসম্মত নয়।
ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের করা আন্দোলন ও সড়ক অবরোধে বৃহস্পতিবারের মতো আজো স্থবির হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। সেই সঙ্গে বিক্ষোভ চলছে রাজশাহী, সিলেট, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষায় ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তাঁরা।