‘সান্ত্বনা শুধু একটাই, তিন ছেলে বেঁচে আছে’

রাজধানীর গুলশান ১-এর ডিএনসিসি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আটটি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে হাজি আবদুল হাকিমের। মার্কেটের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি।
আবদুল হাকিম জানান, তাঁর আটটি দোকানে সাড়ে ৮ থেকে ৯ কোটি টাকার মালামাল ছিল। নিজেই সরাসরি বিদেশ থেকে ক্রোকারিজসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র আমদানি করে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করতেন। গতকালই এনেছিলেন প্রায় ১ কোটি টাকার মালামাল।
আবদুল হাকিম বলেন, ‘আটটি দোকান পুড়ে ছাই হয়েছে। এখন সম্বল আছে শুধু আমার কর্মক্ষম ও উদ্যোগী তিন ছেলে। এরাই এখন আমার সম্পদ। এ ছাড়া আর কিছুই নেই আমার।’
আজ বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নিজের পুড়ে যাওয়া দোকানঘরগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলছিলেন আবদুল হাকিম। নিজের জীবন সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, অভাব আর টানাটানির সংসারের হাল ধরতে হয়েছে কিশোর বয়সেই।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার গোলাপনগর গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ হাকিম জানান, ঢাকায় এসে অন্যের দোকানে কাজ করার একপর্যায়ে কিছু সঞ্চয় করে আজ থেকে প্রায় ২৯ বছর আগে নিজেই একটি দোকান দেই। পর্যায়ক্রমে আটটি দোকানের মালিক হই। তিন ছেলে ইউসুফ, আবু মুসা ও আবু আলী পুরো ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। মাঝে মধ্যে তিনিও তদারিক করেন সবগুলো দোকান।
আগুন লাগার বিষয়ে আবদুল হাকিম বলেন, শুনেছি কাঁচাবাজারের কোনো একটি দোকানঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত। আগুন যেভাবেই লাগুক আমার কিছুই নেই। সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন সান্ত্বনা শুধু একটাই, আমার তিন ছেলে বেঁচে আছে। এটা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই।’
বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুনে নিহতদের প্রতি ইঙ্গিত করে হাজি আবদুল হাকিম এনটিভি অনলাইনকে কাঁদতে কাঁদতে আরো বলেন, ‘যার যায়, শুধু তিনিই বুঝেন কি হারান। আমি আমার সারা জীবনের কষ্টার্জিত সম্পদ সব হারিয়েছি। যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলাম, তা এক নিমিষেই আগুনে নিয়ে গেছে।’
‘বনানীতে তো গত পরশুর (বৃহস্পতিবার) আগুনের ঘটনায় কত মানুষ মারা গেলো। আমার ছেলেরাও তো মারা যেতে পারত। আমি নিজেও তো পুড়ে মারা যেতে পারতাম। আমি বেঁচে আছি, আমার বুকের ধন সন্তানরা বেঁচে আছে এটাই একমাত্র সান্ত্বনা।’
রাজধানীর গুলশান ১-এর ডিএনসিসি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী হাজি আবদুল হাকিম। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম
২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনার কথা উল্লেখ করে আবদুল হাকিম বলেন, ‘সে সময়ও আগুনে আমার সবকিছুই পুড়ে গেছে। ওই সময়ও আমি কিছুই উদ্ধার করতে পারিনি।’
ওই সময় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে আবদুল হাকিম বলেন, ‘ওই সময়ও আগুন লাগার আগের দিনই আমার চামচের একটি বড় চালান এসেছিলো। তাতে প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ টাকার চামচ ছিল। সবগুলো চামচই আগুনে পুড়ে একটি মণ্ড হয়ে যায়। পরে কেজি হিসেবে সেগুলো বিক্রি করে ৭০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম।
ওই সময় সরকার বা অন্য কোনো দপ্তর থেকে সহযোগিতা পেয়েছিলেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল হাকিম বলেন, ‘অনেক আশ্বাস পেয়েছি। কিন্তু বাস্তবে এক পয়সার সহযোগিতাও পাইনি। নিজেরাই আবার নতুন করে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি।’
ডিএনসিসি মার্কেটের পশ্চিম-দক্ষিণ কর্নারে মুদি দোকনটির মালিক হচ্ছেন মোতালেব। দুপুর পৌনে ১২ টার দিকে ভষ্মিভূত হওয়া মার্কেটের ভেতরে মোতালেবের দোকানের সামনে গিয়ে দেখা যায়, অনেকটা পাগলপ্রায় হয়ে তিনি ছাইয়ের নিচে কিছু একটা খুঁজে চলেছেন। আগুন নেভার পর থেকেই তিনি খুঁজতে শুরু করেছেন। সঙ্গে দোকানের কর্মচারীও খুঁজে চলেছেন।
কী খুঁজছেন? মোতালেবের কাছে জানতে চাইলে কোনো উত্তর মিলেনি। বাকরুদ্ধ মোতালেব শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। দুই চোখ থেকে টপটপ করে পানির ফোটা পড়ছে দেখে আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস হয়নি।
কর্মচারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, গতকাল সারাদিনের বেচাবিক্রির সব টাকাই ক্যাশবাক্সে ছিলো। চাল, ডাল, মশলা ও অন্যান্য মুদি-মনিহারী জিনিসপত্রের সঙ্গে টাকাগুলোও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই গুলশান ১-এর ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আজ শনিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মার্কেটের কাঁচাবাজার অংশে ওই আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেন, ভোরে খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট কাজ করে। সেনা ও নৌ বাহিনীর সদস্যরাও পরবর্তী সময়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেন।
ডিএনসিসি কাঁচাবাজার অংশে মূলত বিভিন্ন মুদি ও খাদ্য সামগ্রীর দোকান রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সেখানে প্রায় ৩০০ দোকান রয়েছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মার্কেটটি ঘিরে রেখেছে। তারা শুধু দোকানের মালিকদেরই ভেতরে ঢুকতে দেয়। বাইরের কেউ মার্কেটে যেতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান থেকে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে বেশিরভাগ মালামাল পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেছে।