কৃষিঋণ নিয়ে পরোয়ানার খড়গ ১৪৪ কৃষকের মাথায়

কৃষিঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পারায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর মামলায় ১৪৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
সম্প্রতি কয়েক দফায় মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ের সার্টিফিকেট শাখায় সহস্রাধিক মামলা করেছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, জনতা, অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এসব মামলার পর ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুর রহমান খান পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানা পৌঁছে গেছে মান্দা থানা পুলিশের কাছে।
এদিকে, ঋণ পরিশোধের পরও মামলার দায় থেকে অব্যাহতি পাননি বলেও অভিযোগ করেছেন অনেক কৃষক। স্থানীয়রা বলছেন, ঋণের পর ব্যাংকগুলো সঠিক তদারকি করলে এত বিপুলসংখ্যক কৃষক মামলার (যা সার্টিফিকেট মামলা হিসেবেও পরিচিত) শিকার হতেন না।
ইউএনও কার্যালয়ের সার্টিফিকেট শাখায় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) প্রসাদপুর শাখা ৪৩৪টি, সতীহাট শাখা ১৪৬টি, জোতবাজার শাখা ১৯৩টি, সাবাইহাট শাখা ৪৮টি, জনতা ব্যাংক লিমিটেড মান্দা শাখা ১২৭টি, জোতবাজার শাখা সাতটি, দেলুয়াবাড়ি শাখা ১৬টি, বৈদ্যপুর শাখা নয়টি, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড মান্দা শাখা ১৯টি, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড কশব শাখা ৪৯টি ও মৈনম শাখা পাঁচটি মামলা দায়ের করে।
উপজেলার চককানু গ্রামের কৃষক এনামুল হক জানান, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক প্রসাদপুর শাখা থেকে ২০০৯ সালে তিনি ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ফলন বিপর্যয়, দাম না থাকা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সময়মতো তিনি ওই ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। পরে সেই ঋণ সুদে আসলে ২৬ হাজার ৯৯০ টাকা হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ওই টাকা আদায়ের জন্য মান্দা ইউএনওর সার্টিফিকেট শাখায় মামলা দায়ের করলে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
এরপর ২৩ আগস্ট ২১ হাজার ও ২৪ আগস্ট ছয় হাজার টাকা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় রশিদের মাধ্যমে পরিশোধ করেন এনামুল হক। এরপরও গত ১৯ অক্টোবর তাঁর বিরুদ্ধে আবারও পরোয়ানা জারি করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকের চক্রবৃদ্ধি সুদের ৪৫৫ টাকা ও মাইকিং খরচের ৮০০ টাকা ধরে কৃষক এনামুলের ঋণের হিসাব নম্বরে এখনো ১২৫৫ টাকা অনাদায়ী দেখানো হয়েছে। এ টাকা পরিশোধ না করায় তাকে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (ঋণ পরিশোধের ছাড়পত্র) দেওয়া হয়নি। একই অবস্থার শিকার মান্দার বড়পই গ্রামের দুলাল হোসেন, দেলুয়াবাড়ীর সুলতান আহম্মেদসহ বেশ কয়েকজন কৃষকের।
এদিকে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, টাকা পরিশোধ করে সে তথ্য আদালতকে জানানোর দায়িত্ব ব্যাংকের নয়, ওই কৃষকের। এ বিষয়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক প্রসাদপুর শাখার ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান জানান, ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায়ের জন্য তিনি মামলা করেছেন। কৃষক এনামুল টাকা পরিশোধের পরও কেন বিষয়টি সার্টিফিকেট আদালতকে জানানো হয়নি, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ব্যাংকের জমা রসিদ নিয়ে তা সংশ্লিষ্ট আদালতকে জানানো উচিত ছিল ওই কৃষকের, তাঁর নয়।
ব্যাংকের মাইকিং বিষয়ে ওই কৃষকের কাছ থেকে ৮০০ টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান বলেন, মামলাভুক্ত প্রত্যেক গ্রহীতার কাছ থেকে মাইকিংয়ের জন্য ৮০০ টাকা করে তাদের ঋণের হিসাব নম্বরে যোগ হবে। একদিনে একাধিক গ্রহীতার বিরুদ্ধে মাইকিং হলেও প্রত্যেকের কাছ থেকে একই হারে চার্জ প্রযোজ্য হবে বলে তিনি জানান।
তবে কৃষক এনামুল হক দাবি করেন, ঋণ আদায়ের বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে মাইকিংয়ে কোনো রকম প্রচার-প্রচারণা করেননি। এরপরও তার হিসাবের খাতায় এ বাবদ ৮০০ টাকা দেখানো হয়েছে।
মান্দা উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুর রহমান খান জানান, মান্দা উপজেলায় কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা আছে মোট এক হাজার ১০৩টি। এর মধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মামলা সংখ্যা ৮২০টি। কৃষকদের অনাদায়ী ঋণ আদায়ের জন্য এরই মধ্যে সার্টিফিকেট শাখা থেকে ১৪৪ জন কৃষকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ওয়ারেন্ট জারির কারণে কৃষকরা যদিও ক্ষতিগ্রস্ত হন, তারপরেও টাকা আদায়ের স্বার্থে আমাকে কৃষকের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে হচ্ছে।’
এই পরোয়ানা জারির ফলে বকেয়া অনাদায়ী ঋণ আদায়ে সফলতা দেখা দিয়েছে। অনেক কৃষক একবারে না পারলেও কিস্তির মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধের জন্য এগিয়ে এসেছেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে মান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাফফর হোসেন, ‘আমি বেশ কিছু ওয়ারেন্ট পেয়েছি। ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। আপাতত আমরা তাদের গ্রেপ্তার করছি না।’