কথিত বনবিট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

কাগজে-কলমে লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিক এখনো বনের প্রহরী। কিন্তু এক যুগ ধরেই তিনি নওগাঁর ধামইরহাট বনবিট কর্মকর্তা ও উপজেলা ফরেস্ট অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন। এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে গাছ চোরাচালানসহ সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট বিভাগের ওপর মহলের কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তিনি এসব দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। অভিযোগ উপস্থাপন করে তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি তাঁদের।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৮৩ সালে বন প্রহরী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিক। ওই পদে জেলার মান্দা, নিয়ামতপুর ও ধামইরহাটে বেশ কয়েক বছর তিনি চাকরি করেন। আলোচিত সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ওসমান গনির সময়ে রহস্যজনকভাবে হঠাৎ করেই ধামইরহাট বনবিট কর্মকর্তার দায়িত্ব পান তিনি। ওই সময় তিনি নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দেন কর্মকর্তার পদবি।
জেলার পত্নীতলা পাইকবান্দার রেঞ্জ কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম বলেন, বনবিট কর্মকর্তার পদটি টেকনিক্যাল। এই পদের জন্য ন্যূনতম ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি সার্টিফিকেট থাকতে হয়। লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিকের মূল পদবি বন প্রহরীর। কীভাবে এক যুগ ধরে তিনি এই পদে আছেন, তা রহস্যজনক।
রেজাউল ইসলাম আরো বলেন, পাইকবান্দা রেঞ্জের আওতায় জেলার ধামইরহাট ও পত্নীতলা উপজেলার প্রায় চার হাজার একর এলাকাজুড়ে রয়েছে বিশাল বনাঞ্চল। এসব বনে আছে শাল, সেগুন, মেহগনি, আকাশমণিসহ প্রায় ২৫০ প্রজাতির বনজ ও ফলদ গাছ। এ ছাড়া আছে আলতাদীঘি শালবনসহ দুটি প্রাকৃতিক বন। এসব বনের গাছ পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি। এ কর্মসূচির আওতায় আছেন প্রায় ১১ হাজার উপকারভোগী সদস্য।
স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ, এক যুগ ধরে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির নামে লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিক গাছ-কাঠ পাচার, অর্থ লোপাট, উপকারভোগীদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।
ধামইরহাট উপজেলার রাঙামাটি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা নূরুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম, রাঙামাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজওয়ান, আলমপুর গ্রামের মাহফুজুল ইসলাম, কাজেম উদ্দিন, আবদুল গোফ্ফারসহ কয়েকজন বাসিন্দার অভিযোগ, লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিক বনের গাছ-কাঠ পাচারের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তাঁদের দাবি, এলাকার প্রভাবশালী আবু বক্কর সিদ্দিক, সিজন, জাহেরুল, মুসলিন ওই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। এরা আবার সরাসরি সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির সঙ্গেও সম্পৃক্ত (উপকারভোগী সদস্য)।
স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ, লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির শুরুতেই সদস্য করার নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নেন। এভাবে তিনি কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বন বিভাগের হিসাবের খাতায় ১১ হাজার সদস্য থাকলেও আরো অন্তত পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। টাকা নিয়ে ভুয়া সনদও দেওয়া হয়েছে তাঁদের। এলাকাবাসী আরো অভিযোগ করেন, টেন্ডার না করেই গোপনে বনের গাছ কেটে পাচার করছে লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিকের সিন্ডিকেট। বনের গাছ কাটার পর আলামত নষ্ট করতে আবার সেখানেই লাগানো হয় চারাগাছ। এ কারণে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। স্থানীয়রা আরো দাবি করেন, বন বিভাগের ওপর মহলের কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই সামাজিক বনায়নে যাচ্ছেতাই করছেন লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিক।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, প্রচারণা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন এলাকাবাসী। অভিযোগের ভিত্তিতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম এরই মধ্যে লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত সম্পন্ন করেছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন বলেন, তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে গত বৃহস্পতিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে না চাইলেও সাংবাদিকদের বলেন, লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
কথিত বনবিট কর্মকর্তা লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিক নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য একটি মহল নানা তৎপরতা চালাচ্ছে।’
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ইমরান আহম্মেদ সাংবাদিকদের বলেন, কর্মস্থলে নতুন যোগদান করায় এলাকার সব বিষয় সম্পর্কে তিনি অবগত নন। বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে প্রমাণ পেলে লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।