সুপারিতে সুদিন

কেশবপুর অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন সুপারিশিল্পকে ঘিরে। দুই সহস্রাধিক নারী পানের খিলির জন্য প্রয়োজনীয় সুপারি কাটার কাজ করে পরিবারে এনেছেন সচ্ছলতা। জলাবদ্ধতার সমস্যায় জর্জরিত এই অঞ্চলের মানুষ এখন সুপারিশিল্পকে ঘিরে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন।
যশোরের কেশবপুরের ঐতিহ্যবাহী বিল গরালিয়া ছিল এলাকার ৩০ গ্রামের মানুষের সোনালি স্বপ্ন। কিন্তু কয়েক দশকের জলাবদ্ধতায় এলাকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের পুরুষরা হয়ে পড়েন অসহায়-কর্মহীন। গ্রামের প্রতিটি পরিবারের মানুষের কাটছিল অভুক্ত, মানবেতর জীবন। অভাবে পড়ে অনেক পুরুষ এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে চলে গেছেন অন্যত্র। অর্থের অভাবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। গাছগাছালি, গরু-ছাগল ও জলাবদ্ধ জমি পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন এসব অসহায় পরিবারের মানুষ।
এমনই পরিস্থিতিতে পরিবারের প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রথাবদ্ধ রীতির খোলস ছেড়ে সুপারি টুকরো করার কাজ করে সংসারে অভাব-অনটন কাটিয়ে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এনে পরিবারের হাল ধরেছেন এলাকার নারীরা। তাঁরা হয়ে উঠেছেন পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিত্বে। খতিয়াখালি গ্রামের সফল এই গৃহবধূরা হয়ে উঠেছেন নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক।
নারীদের এ কাজের সুযোগ করে দেন খতিয়াখালি গ্রামের পিতা-পুত্র লক্ষ্মণ দাস ও উত্তম দাস। তাঁরা সুপারিপ্রধান এলাকা বাগেরহাটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সুপারি কিনে এনে পানের খিলির উপযোগী করে টুকরো করার জন্য গ্রামের নারীদের কাছে সরবরাহ করেন। প্রতি কেজি সুপারি টুকরো করার জন্য তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় ১৩ টাকা। একেকজন নারী প্রতিদিন ১২ থেকে ১৬ কেজি সুপারি টুকরো করে ১৫০-২০০ টাকা আয় করছেন। তাঁদের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ কাজ শুরু করেছেন পার্শ্ববর্তী বালিয়াডাঙ্গা, সুজাপুর ও ব্রহ্মকাটিসহ চার গ্রামের ২০ হাজার নারী-পুরুষ।
অভাবী পরিবারের স্কুল-কলেজপড়ুয়া মেয়েরাও এখন লেখাপড়ার পাশাপাশি সুপারি টুকরো করার কাজ করছে। লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে পারিশ্রমিকের অর্থ তুলে দিচ্ছে পরিবারের কাছে।
তবে পুঁজি সংকট আর সরকারি সুযোগ-সুবিধার অভাবে এ শিল্পকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ আর সরকারি সহায়তা পেলে সুপারি টুকরো করার এই কাজ লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস হতে পারে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
এ ব্যাপারে সুপারি ব্যবসায়ী উত্তম দাস বলেন, ‘বিল গরালিয়াসহ আশপাশের এলাকা ৩০ বছর ধরে জলাবদ্ধ ছিল। এলাকার মানুষ সংসার চালাতে গাছগাছালি, গরু-ছাগল ও জলাবদ্ধ জমি পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কাজের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে অনেক পুরুষ চলে যায় অন্যত্র। তখন আমি ও আমার বাবা লক্ষ্মণ দাস দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সুপারি কিনে এনে পানের খিলির জন্য সুপারি টুকরো করতে গ্রামের নারীদের কাছে সরবরাহ করি। এক কেজি সুপারি টুকরো করার জন্য মজুরি হিসেবে তাঁদের দেওয়া হয় ১৩ টাকা। একেকজন নারী প্রতিদিন সুপারি টুকরো করে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় করে থাকেন। সুপারি কেটে এভাবে গ্রামের অসহায় মানুষ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হচ্ছে।’
পুঁজির অভাবে ব্যবসা ঠিকমতো চালাতে পারছেন না, এমন হতাশাও প্রকাশ পায় উত্তমের কথায়, ‘স্বল্প সুদে ঋণের আশায় বিভিন্ন ব্যাংকে ধরনা দিয়েও ঋণ পাওয়া যায়নি। ঋণ পাওয়া গেলে ব্যবসার প্রসারের পাশাপাশি এলাকার হাজার হাজার নারী বাড়িতে বসেই হাজার হাজার টাকা আয় করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারতেন।’
খতিয়াখালি গ্রামের আরেক সুপারি ব্যবসায়ী পার্বতী রানী দাস জানান, ৭০ জন নারী শ্রমিক তাঁর বাড়ির উঠানে বসে সুপারি টুকরো করে থাকেন। পুঁজির অভাবে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পারছেন না। তিনিও স্বল্প সুদে ঋণের আশায় ব্যাংকে ব্যাংকে ধরনা দিয়েছেন, কিন্তু মেলেনি ঋণ। ব্যাংক ঋণ পেলে ব্যবসার পরিধি যেমন বাড়তে পারত, তেমনি এলাকার হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হতো। এমনটাই মনে করেন তিনি।
খতিয়াখালি গ্রামের মল্লিকা রানী দাস জানান, তিনি প্রতিদিন সুপারি টুকরো করে ২০০ টাকা পান। মাসে আয় হয় ছয় হাজার টাকা। এই টাকা থেকে তিনি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে অবশিষ্ট টাকা স্বামীর হাতে তুলে দেন। একইভাবে রাখী দাস, রীনা দাস, শিখা দাস, মিতা দত্ত ও পারভীনা খাতুন জানান, তাঁরাও সুপারি টুকরো করে প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা আয় করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
কেশবপুর মহিলা কলেজের ছাত্রী রিপা দাস ও কেশবপুর পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সুপ্তী দাস জানায়, তারাও লেখাপড়ার পাশাপাশি সুপারি টুকরো করে পারিশ্রমিকের অর্থ তুলে দিচ্ছে মা-বাবার হাতে।
এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলাউদ্দিন জানান, দীর্ঘদিন জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে এলাকার মানুষ অসহায় হয়ে পড়লেও সুপারিশিল্পে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। সুপারিশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের ঋণের জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করলেও কোনো ব্যাংক ঋণ দেয়নি।
কেশবপুর কৃষি ব্যাংক শাখার ব্যবস্থাপক তুষার কান্তি সরকার জানান, সুপারি হস্তশিল্পের জন্য ঋণ দেওয়ার কোনো স্কিম কৃষি ব্যাংক শাখায় নেই। তবে তারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখেছেন, শত শত নারী বাড়িতে বসে সুপারি কেটে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন। এই কাজের জন্য ঋণ দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না, সে ব্যাপারে তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বলে আশ্বাস দেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ রায়হান কবির গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নে এই সুপারি টুকরো করার কাজে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণসহ সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।