রসে ভেজানো পিঠার সময়

শীতের পিঠা-পায়েস মানেই খেজুর-রস আর গুড়-পাটালির ব্যবহার। হেমন্তে আমন ধান কাটার পরপরই গ্রামাঞ্চলে শত রকমের পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। পাকান, চন্দ্রপুলি, কুলি, ভাপা আর রসে ভেজানো পিঠার কথা শুনলে আমাদের সবারই শীতকালের কথা মনে পড়ে।
চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি কাঁচিপোড়া পিঠা আর খেজুরের গুড় কিংবা খেজুরের রস দিয়ে তৈরি নানা ধরনের পায়েস ও ক্ষীরের স্বাদ তো অমৃতসম। আর যশোরের গুড়ের সন্দেশের খ্যাতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
দেশের সব স্থানেই কমবেশি খেজুর গাছের দেখা মিললেও যশোরের খেজুর রস আর গুড়-পাটালি ভুবন বিখ্যাত। যে কয়েকটি বিষয়ের কারণে বাইরের মানুষ যশোরকে চিনেছে, তার মধ্যে অন্যতম এই খেজুর রস আর গুড়-পাটালি।
‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’—প্রবাদবাক্যসম এ কথাটি তো সবারই জানা।
খেজুর-রস সংগ্রহ
বর্ষা শেষে প্রকৃতিতে যখন শীতের আগমনবার্তা স্পষ্ট হতে শুরু করে, খেজুর গাছ কাটা (রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা) শুরু করেন গাছিরা। গাছের মাথা থেকে ১০/১২ ইঞ্চি নিচে কিছুটা জায়গা ধারালো দা দিয়ে কেটে পরিষ্কার করা হয়। পরিষ্কার করা জায়গার মাঝখানে কৌণিক আকারে দুটি গভীর দাগ কাটা হয়। দাগ দুটির মিলনস্থলে বাঁশের সাত-আট ইঞ্চি লম্বা একটি নল পুঁতে দেওয়া হয়।
এই নলের মাথায় একটি মাটির পাত্র গাছের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। গাছের কাটা অংশ দুই-তিন দিন পরপর নতুন করে চেঁছে পুরো শীত মৌসুম গাছ থেকে রস আহরণ করা হয়।
বিকেলে গাছ কেটে মাটির ভাঁড় বা ঠিলে ঝুলিয়ে ভোরে তা গাছ থেকে নামানো হয়। একটি সুস্থ-সবল গাছ থেকে প্রতি রাতে এক ঠিলে রস পাওয়া যায়। প্রথমবার গাছ কাটার পর প্রথম রাতে যে রস পাওয়া যায়, গুণ-মানের দিক থেকে তা সবচেয়ে ভালো।
স্থানীয়ভাবে একে ‘জিরেন রস’ বলে। গাছ কাটার দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনও ক্রমাগত রস ঝরতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রসের গুণমান নিচে নামতে থাকে। তবে রসের মান কেমন হবে, তা সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে গাছির দক্ষতা ও নিপুণতার ওপর।
গুড়-পাটালি তৈরি
সূর্য ওঠার আগে খুব ভোরে গাছ থেকে রস নামিয়ে বাড়িতে নিয়ে যান গাছিরা। এরপর একটি বড় চুল্লিতে রস জাল দেওয়া হয়। তিন-চার ঘণ্টা জাল দেওয়ার পর রস শুকিয়ে ঘন হয়ে একপর্যায়ে তা গুড়ে পরিণত হয়।
প্রথম দিনের রস থেকে সবচেয়ে ভালো মানের গুড় ও পাটালি পাওয়া যায়। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের রস থেকে তৈরি হয় ঝোলা গুড়। গুড়েরই আরেক রূপ পাটালি। রসের রং সরষে ফুলের মতো হয়ে উঠলে তখন খানিকটা পুরোনো গুড় পাত্রের একপাশে নিয়ে ক্রমাগত ঘষে ঘষে (স্থানীয় ভাষায় একে ‘বীজ মারা’ বলে) ফের পাত্রের গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে পাত্রের সব গুড়ই দানা বেঁধে পাটালি হয়ে যায়।
যশোরের খেজুরের রসের কেন এত যশ?
যশোরের মাটি ও আবহাওয়া খেজুর গাছের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষিবিদরা জানান, এ এলাকার মাটি অ্যালকালাইন শ্রেণির। এ ধরনের মাটিতে অ্যাসিডিটি ও স্যালাইনের পরিমাণ কম। আর সে কারণেই এ এলাকার মাটিতে সহজেই খেজুর গাছ জন্মায় এবং কোনোরকম পরিচর্যা ছাড়াই তা বেড়ে ওঠে। এ ছাড়া যশোরে শীতকালে প্রচণ্ড শীত অনুভূত হয়। শীত যত বেশি হয়, খেজুর রস তত সুস্বাদু হয়।
যশোরের খেজুর রস গুড়-চিনির ঐতিহাসিক তথ্য
ঠিক কবে থেকে যশোর অঞ্চলে খেজুর গাছের চাষ শুরু হয়, তা এখন আর জানা সম্ভব নয়। তবে ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্রের মতে, সুপ্রাচীনকাল থেকে যশোরের চাষিরা খেজুর গাছ কেটে তা থেকে রস বের করে গুড় ও চিনি তৈরি করে আসছেন।
ব্রিটিশ আমলে বেশ কয়েকজন সাহেব গুড়-চিনি তৈরিকে রীতিমতো শিল্প হিসেবে দাঁড় করিয়ে ফেলেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের ধোবা নামক স্থানে ব্লেক সাহেব কুঠি স্থাপন করে চিনি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
কিন্তু অব্যাহত লোকসানের মুখে তিনি কোম্পানি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। একই সময়ে যশোরের চৌগাছায় গুড়-চিনির কারখানা তৈরি করে কলকাতার গ্লাডস্টোন উইলি অ্যান্ড কোং।
এর পর যশোরের কেশবপুর, ত্রিমোহিনী, ঝিকরগাছা, নারকেলবাড়িয়া ও ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে এই কোম্পানি কারখানা গড়ে তোলে। ১৮৬১ সালে নিউহাউস সাহেব ভৈরব ও কপোতাক্ষ নদের মিলনস্থল চৌগাছার তাহিরপুরে একটি চিনির কল স্থাপন করে ইউরোপীয় কায়দায় চিনি প্রস্তুত করা শুরু করেন।
একই সঙ্গে এ কারখানায় মদও তৈরি হতো। ১৮৮৪ সালে কোম্পানিটি নিউ হাউস সাহেবের হাতছাড়া হয়। পরে কোম্পানি দেশীয় জমিদার ও বণিকদের হাতে গেলেও তারা এই কারখানাগুলো আর টিকিয়ে রাখতে পারেনি।
বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের তথ্য (১৯০৮ সালে প্রকাশিত) অনুযায়ী, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও যশোরের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু চিনি ও গুড় তৈরির কারখানা ছিল।
১৯০০-০১ সালে যশোরের ১১৭টি কারখানায় ১৫ লাখ টাকার চিনি উৎপাদিত হয়েছিল। সে বছর সমগ্র বঙ্গে (পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ) ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ চিনির মধ্যে শুধু যশোরেই উৎপাদিত হয় ১৭ লাখ নয় হাজার ৯৬০ মণ।
যশোর জেলা গেজেটিয়ার থেকে জানা যায়, ১৯৭০-৭১ সালে এ জেলায় (বৃহত্তর যশোর, যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইল ও মাগুরা) খেজুর চাষের আওতায় জমির মোট পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ১৫৫ একর। এর মধ্যে আট হাজার ৮৫৫ একর জমির খেজুর গাছ থেকে রস পাওয়া যেত। সে সময় একরপ্রতি সাড়ে ২২ টন হিসেবে বার্ষিক রসের উৎপাদন ছিল দুই লাখ ৫৩ হাজার ৭২৫ টন।
১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার জরিপ রিপোর্টে বৃহত্তর যশোর জেলায় সাত হাজার ১৯৩টি গুড় তৈরির কারখানা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। অবশ্য এসব কারখানার সবই গৃহভিত্তিক। ইংরেজ আমলের পর যশোরে খেজুর রস দিয়ে গুড় বা চিনি তৈরির বৃহৎ কোনো কারখানার অস্তিত্ব এখন আর নেই।
এখন অস্তিত্ব সংকটে খেজুর গাছ
ইটভাটার আগুনের জন্য খেজুর গাছ খুবই উপযোগী। আর সে কারণে ইটভাটা মালিকদের কাছে খেজুর গাছের চাহিদাও বেশি। প্রতি মৌসুমে বিপুল সংখ্যক খেজুর গাছ ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তবে বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য শুধু ইটভাটাই দায়ী নয়। রস-গুড় উৎপাদন করে মানুষ যদি লাভ করতে না পারে, তাহলে খেজুর গাছের সংখ্যা কমবেই।
তা ছাড়া খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ এবং গুড়-পাটালি তৈরি খুবই সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর কাজ। সুনিপুণ দক্ষতারও প্রয়োজন হয়। নতুন প্রজন্ম এত কষ্টের কাজ এখন আর করতে চাইছে না।
ফলে এখন দক্ষ গাছিও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক স্থানে খেজুর গাছ থাকলেও গাছির অভাবে সেগুলো থেকে রস সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ এবং তা থেকে গুড়-পাটালি তৈরির প্রক্রিয়াটি আরো আধুনিক ও সহজ করতে পারলে এ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক, গবেষক বেনজীন খান বলেন, ‘বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে যশোরে এত বিপুল সংখ্যায় খেজুর গাছ জন্মে। এই গাছ বিনাশের মাধ্যমে আমদানি করা গাছের বাগান সৃজন করে আমরা প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছি।’
তিনি বলেন, ‘রস-গুড়ের সঙ্গে যশোর অঞ্চলের মানুষের সামাজিক সম্পর্ক, প্রেম-ভালোবাসা জড়িত। শীতকালে প্রতিটি বাড়িতেই একসময় পিঠা-পায়েস দিয়ে মেয়েজামাইকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। এখন আর তা চোখে পড়ে না। ফলে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে দূরত্বও বাড়ছে।’