সেলিম ওসমানের উচ্চ প্রশংসা হেফাজতে ইসলামের

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠ-বস করানোয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের উচ্চকিত প্রশংসা করে তাঁর পক্ষে অবস্থানের কথা ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।
আজ শুক্রবার হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামে এক ফেসবুক পেজে প্রচারিত ভিডিওবার্তায় সংগঠনটির মহাসচিব আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের প্রশংসা করে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
সেলিম ওসমানের অবস্থানের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়ে মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের স্কুলের প্রধান শিক্ষক দশম শ্রেণির ছাত্রদের হট্টগোল থামানোর জন্য বলেছেন, ‘তোমরাও নাপাক, তোমাদের আল্লাহও নাপাক’। মাস্টার আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শানে গোস্তাকী করেছে, কটাক্ষ করেছে। নারায়ণগঞ্জের জনগণ উত্তেজিত হয়ে তাঁর ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে। তখন ওই এলাকার এমপি সেলিম ওসমান সাহেব উত্তেজনা থামানোর জন্য জনগণের হামলা থেকে ওই মাস্টারকে রক্ষা করার জন্য তাকে কান ধরাইছে। এরপর কিছু ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়া এমপি সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ওই মাস্টারের পক্ষ অবলম্বন করেছে। সেলিম ওসমানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে না জানলেও তাঁর এই পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। কারণ আল্লাহতায়ালাকে শুধু মুসলমানরা নয়, সব জাতিরা, সমস্ত মানুষ আল্লাহতায়ালাকে মানে এবং আল্লাহতায়ালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই অবস্থায় ওই হিন্দু মাস্টার আল্লাহতায়ালার সঙ্গে কটাক্ষ করে কোটি কোটি মুসলমানসহ সমস্ত মানুষের হৃদয়ে আঘাত দিয়েছে। এমপি সাহেব যে তার কান ধরিয়েছে, এটা এমপির অপরাধ না।’
শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় সেলিম ওসমানের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সমালোচনা করে বাবুনগরী বলেন, ‘ওই মাস্টারের পক্ষ নিয়ে যারা কান ধরা দিবস পালন করতেছে, তাঁরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মাহবুবউল্লাহ সাহেবের ওপর কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র হামলা করে তাঁর গায়ের জামা ছিঁড়ে দিয়েছিল, তখন তারা কোথায় গিয়েছিল। শাপলা চত্বরে হাজার হাজার ওলামাকে যখন কান ধরাইছে, তখন তারা কোথায় গিয়েছিল।’
পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের কমিটির প্রশংসা করে বাবুনগরী বলেন, ‘আমি সেলিম ওসমান সাহেবের এই পদক্ষেপের পক্ষে। সেলিম ওসমানের এই কাজ অত্যন্ত প্রশংসনীয় মনে করতেছি এবং যে কমিটি ওই মাস্টারকে বহিষ্কার করেছে, কমিটির এই পদক্ষেপও অনেকটা প্রশংসনীয়। এই অবস্থায় যারা আল্লাহতায়ালার সঙ্গে অপমান করবে, আল্লাহতায়ালার সাথে বেয়াদবি করবে, ইসলামের অবমাননা করবে-আমি জনগণের প্রতি আহ্বান করব তারা যেনে সুশৃঙ্খলভাবে এ সমস্ত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।’
সরকারের প্রতি ইসলামবিদ্বেষীদের শাস্তি প্রদানের আহ্বান জানিয়ে বাবুনগরী বলেন, ‘আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করে বলব, সরকার যেন সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এ সমস্ত ইসলামবিদ্বেষী, আল্লাহর দুশমন, আল্লাহর শত্রু, রাসুলের দুশমনদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে। না হলে দেশে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হবে। আমরা সাম্প্রদায়িকতা চাই না। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। আমরা চাই এখানে মুসলমান হিন্দু সবাই শান্তির সঙ্গে বসবাস করুক। কিন্তু ধর্ম নিয়ে কেউ যদি কটাক্ষ করে, আল্লাহতায়ালার সঙ্গে যদি বেদায়বি করে, তাহলে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা দেশের শান্তি চাই। ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ওই হিন্দু মাস্টারের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি প্রদান করতে হবে। দেশের শান্তি চাই। সেলিম ওসমানের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আল্লাহতায়ালা আমাদের ইসলামের পক্ষে কথা বলার জন্য তৌফিক দান করুক।’
ভিডিওবার্তায় বাবুনগরী আরো বলেন, ‘এই ইসলাম অবমাননাকারী হিন্দু মাস্টারকে যে স্কুল কমিটি বহিষ্কার করেছে আবার তাঁকে পুনর্বহাল করার অর্থ হলো ইসলামবিদ্বেষী, ইসলাম অবমাননাকারীদের পুরস্কৃত করা। ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে যদি ইসলাম অবমাননাকারীদের পুরস্কৃত করা হয় তাহলে কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়ে আঘাত হানা হবে। তখন এ দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা হবে না। আমি সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, এই হিন্দু মাস্টারের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হয় এবং যারা ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করবে তাদেরও যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’
উল্লেখ্য, গত ১৩ মে শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের একটি মসজিদ থেকে হঠাৎ করেই মাইকে ঘোষণা করা হয়, স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ইসলামের বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছেন। এ সময় সেখান থেকে এলাকাবাসীকে স্কুল মাঠে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দলে দলে স্কুলে ঢোকে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। তাঁরা স্কুলের দরজা ভেঙে ঢুকে প্রধান শিক্ষককে মারধর করে এবং তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
পরে সেখানে পুলিশ উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হওয়ার পর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানকে ঘটনাস্থলে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। সংসদ সদস্য উপস্থিত হয়ে প্রধান শিক্ষককে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠ-বস করার শাস্তি দেন।
কান ধরে ওঠ-বসের পর সমবেত জনতার কাছে করজোড়ে মাফ চাইতেও বাধ্য করা হয় ওই প্রধান শিক্ষককে। পরে সংসদ সদস্যের নির্দেশে প্রধান শিক্ষককে পুলিশের হেফাজতে স্কুল থেকে বের করা হয়। এরপর পুলিশ চিকিৎসার জন্য তাঁকে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
বাবুনগরীর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেডে এক সংবাদ সম্মেলনে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানও কটূক্তির কথা উল্লেখ করেছিলেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সেলিম ওসমান বলেন, ‘ঘটনার সময় যখন প্রধান শিক্ষককে আমি বলি, ইসলাম নিয়ে আপনি কটূক্তি করছেন কি না। তখন তিনি বলেন, আমার মাথা ঠিক ছিল না। কি বলেছি বলতে পারছি না। প্রধান শিক্ষকের এমন কথায় প্রমাণ হয় তিনি একজন মানসিক রোগী। আর একজন মানসিক রোগী কীভাবে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।’
এদিকে সেলিম ওসমানের এমন বক্তকে উড়িয়ে দিয়ে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেলিম ওসমান নিজেকে বাঁচাতে অনেক কিছু বলতে পারেন। আমি যদি মানসিক রোগী হয়ে থাকি তাহলে তো আমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো।’
শিক্ষক শ্যামল কান্তি আরো বলেন, ‘ঘটনার দিন বিকেলে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান আমার কক্ষে আসেন। তখন আমি চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। উনি (সেলিম ওসমান) ভেতরে প্রবেশ করার পর আমি তাকে সালাম দিয়ে শুধু স্যার বলতে পেরেছিলাম। উনি ভেতরে প্রবেশ করে আমার কোনো কথা না শুনে দুই হাত দিয়ে আমার দুই গালে চারটি থাপ্পড় মারেন। পরে আমাকে বাইরে এনে বলেন, ‘শালা কান ধর ১০ বার কান ধরে উঠ-বস করবি। আমি কয়েকবার কান ধরে উঠ-বস করার পরেই পড়ে যাই। পরে আমাকে হাত ধরে ওঠানোর পর সংসদ সদস্য বলেন, এই শালা মাফ চা। আমি মাফ চাইলে আমাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমাকে প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয়।’
নির্যাতিত প্রধান শিক্ষক আরো বলেন, ‘আমি তাঁর কাছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার কথা স্বীকার করিনি। এটি সম্পূর্ণ রূপে মিথ্যা কথা। যদি তার (সেলিম ওসমান) কাছে কোনো প্রমাণ থাকে তাহলে তা দেখানো হোক। আমি জীবদ্দশায় কখনো ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করিনি। আর উনি (সেলিম ওসমান) পলিটিক্যাল লিডার। নিজেকে সেভ করার জন্য কত কিছুই বলতে পারেন।’
থাপ্পড় মারার বিষয়টি আগে কেন বলা হয়নি এমন প্রশ্নে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘তখন আমি ভয়ে বলিনি। তিনি আমাকে বলেছেন আপনি আমাকে সেভ করেন আমিও আপনাকে সেভ করব। উনি নিজে আমাকে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন। আমাকে সেলিম ওসমানের এক লোক প্রলোভন দেখায় বাইরে পাঠানোর জন্য। সে আমাকে বারবার কল করে বলেছে, যত সুযোগ-সুবিধা চান আপনাকে দেওয়া হবে। চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠানো হবে।’
শিক্ষামন্ত্রীর স্বপদে পুনর্বহালের ঘোষণার বিষয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সবাইকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই। তবে শুধু সেলিম ওসমান ছাড়া।’
ওই শিক্ষক আরো বলেছিলেন, ‘এখন আমি সেলিম ওসমান আতঙ্কে আছি। আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাকে হুমকি দেওয়া হতে পারে। থানা প্রশাসন সবই তার হাতে। আমি সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন বোধ করছি। সেলিম ওসমান বরখাস্ত হলেই আমি নিরাপদে থাকব। আমি ওনার বরখাস্ত কামনা করছি।’