বাংলাদেশের স্বার্থ দেখার লোক সরকারে নেই : আনু মুহাম্মদ
বাংলাদেশের স্বার্থ দেখার লোক সরকারের মধ্যে নেই বলে জানিয়েছেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, ভারতের করপোরেট স্বার্থ রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার রামপালে সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। সরকার চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কাজ করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে আজ শুক্রবার সিলেটে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির বিভাগীয় সমাবেশে আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন। বিকেলে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ওই সমাবেশ হয়।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের কথা বলে অসংখ্য প্রাণের সমষ্টি সুন্দরবন ধ্বংস করে সর্বনাশা রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ভারতের কোম্পানির স্বার্থে করা হচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, বিশ্ব ঐতিহ্য এই সুন্দরবন তার অসাধারণ জীববৈচিত্র্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে, লাখ লাখ জীবিকার সংস্থান করে, প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশকে ঢাল হিসেবে বাঁচিয়ে রাখে।
‘সুন্দরবনকে ধ্বংস করে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না। সুন্দরবনকে অরক্ষিত করে, সুন্দরবনকে বিনাশ করে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্থনৈতিকভাবে, পরিবেশগতভাবে কোনো ধরনের যুক্তির দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণের কথা আমরা জানি, তথ্য-উপাত্তের কথা আমরা জানি। অনেকভাবে আমরা প্রমাণ করেছি এবং সারা বাংলাদেশে, ভারতে এবং বিশ্বব্যাপী এই বিষয়ে আমরা কোনো বিশেষজ্ঞ পাইনি যিনি সৎ, যিনি দায়িত্বশীল, যিনি বিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে দেখেন ও কোনো স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত না, এমন একজন বিজ্ঞানীকে আমরা পাই না যিনি বলেন- রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। কারা বলে ক্ষতি হবে না? তাদের আমরা চিনি, তাদের আমরা জানি। বিজ্ঞানের চাইতে টাকা তাদের কাছে বড়, তারা বিজ্ঞান দিয়ে কথা বলে না, তারা টাকা দিয়ে কথা বলে। টাকা, স্বার্থ এবং এগুলো দিয়ে যারা ভাড়ায় নিযুক্ত হয়, সেই ধরনের তথাকথিত বিশেষজ্ঞরাই কেবল বলতে পারে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলেও কোনো ক্ষতি হবে না, সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না।’
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরো বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের বহু বিকল্প আছে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। সরকার ভারতের কোম্পানির স্বার্থ দেখায় এবং কোম্পানি ও সরকার একাকার হওয়ার কারণে আজকে আমরা কোম্পানির প্রচারণা দেখি- দরকার হলে আমরা আরেকটা সুন্দরবন বানাব, আমরা আরেকটা সুন্দরবন বানাচ্ছি, গাছ লাগাচ্ছি। আমরা কয়েক বছর আগে যখন সুন্দরবনের দিকে লং মার্চ করলাম, তখন বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছিলেন, দরকার হলে আমরা আরেকটা সুন্দরবন বানাব। আমরা এটাকে একটা নির্বোধের উক্তি হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। আজকে দেখছি, এটা নির্বোধের উক্তি নয়, এটা সুচতুর বক্তব্য যেটা কোম্পানি বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করেছে, বলছে যে আমরা আরেকটা সুন্দরবন বানাচ্ছি। কীভাবে? কয়েক লাখ গাছ লাগিয়ে। গতকাল দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, পাঁচ লাখ গাছ লাগানো হবে। প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করি, উপকূলীয় অঞ্চলে তো বহু সময়ে বহু লাখ গাছ বহু প্রকল্পের অধীনে লাগানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে বলি, সেই গাছগুলোর একটু হিসাব নেন, সেই গাছগুলো কোথায়? সেটা হচ্ছে প্রথম। দ্বিতীয় হচ্ছে, পাঁচ লাখ গাছ কেন, নয় লাখ, দশ লাখ গাছ, গাছ এবং বন এক কথা নয়। একটা প্রাকৃতিক বন বহু হাজার বছরে, বহু লাখ বছরে গড়ে ওঠে। তার মধ্যে যে প্রাণবৈচিত্র্য তৈরি হয় সেটি তার শক্তি নির্ধারণ করে। বনের বিকল্প গাছ হতে পারে না। গাছ লাগিয়ে আরেকটা সুন্দরবন বানানো হবে এর চেয়ে দুর্বৃত্ত কথা, মানে গাছ এবং বন এটাকে একাকার করে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। এই ধরনের যুক্তি দিয়ে তারা জনগণের সামনে পরাজিত। কারণ যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বোঝেন এটা কতটা ভুল, কতটা নির্বোধের উক্তি।’
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব বলেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দিয়েও বোঝাতে পারছি না। পারছি না কেন? যেখানে কোনো স্বার্থের যোগ থাকে, সেখানে যদি কোনো দায় থাকে, যদি সেখানে মাথা নত করার কোনো ব্যাপার থাকে। বাংলাদেশ ভারতের করপোরেট স্বার্থ রক্ষা করার জন্য এটা করছে। চীনের করপোরেট স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কাজ করছে। রাশিয়ার করপোরেট স্বার্থ রক্ষা করার জন্য গ্যাস খাতে নানা কাজ করছে। মার্কিন করপোরেট স্বার্থ ব্যবসায়িক স্বার্থ বঙ্গোপসাগর দিচ্ছে। শুধু বাংলাদেশের স্বার্থ দেখার লোক সরকারের মধ্যে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।’
রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আগামী ১৮ অক্টোবর আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি দেব। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ২৮ জুলাই দিয়েছি। আমরা আশা করব দুই সরকারের প্রধান তাদের আলোচনার ভিত্তিতে এই সুন্দরবন বিনাশী রামপাল তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প যৌথভাবে বাতিল করবেন। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে ভারতের লাভ হবে না, তাদের জনগণের লাভ হবে না। কিছু কোম্পানির লাভ হতে পারে।’
‘বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিল না হলে আমাদের তো উপায় নাই, আমাদের সুন্দরবন তো রক্ষা করতেই হবে। কারণ বাংলাদেশকে তো আমাদের রক্ষা করতে হবে। এই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে, বাংলাদেশকে যা খুশি তাই করা হবে; বাংলাদেশকে ভারত, চীন, রাশিয়া, আমেরিকার মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করা হবে, বাংলাদেশের জনগণের জনজীবন ছিন্নভিন্ন করা হবে- এটা তো বাংলাদেশের কোনো নাগরিক চাইতে পারে না।’ বলছিলেন আনু মুহাম্মদ।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি সিলেট জেলা শাখার সভাপতি ব্যারিস্টার মো. আরশ আলীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন সুমনের পরিচালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য ফকরুদ্দিন কবির আতিক, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য আমিরুন নুজহাত মনিষা ও ওয়ার্কার্স পার্টির সিলেট জেলা সভাপতি সিকান্দর আলী।