অবসরের টাকায় ‘জ্ঞানের বাগান’

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাধারণ একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শেষ করেছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামের নাসির মাস্টার (৬৮)। কিন্তু জীবনটা সাধারণভাবে কাটাননি তিনি। চাকরির পাশাপাশি স্থানীয় শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন।
আর আজ নাসির মাস্টার একক প্রচেষ্টায় নিজের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছেন বিভিন্ন ধরনের ফলের বাগান, শিশুদের জন্য পাঠাগার ও বিনোদন কেন্দ্র। মায়ের নামে এই কেন্দ্রের নাম দিয়েছেন ‘কুলছুম নেছা শিশু পার্ক ও পাঠাগার’।
চাকরিরত অবস্থাতেই একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন এসব। বিনোদন কেন্দ্রটি গড়ে তুলতে আগেই তুলে ফেলেছেন অবসর ভাতার কিছু অংশ। আর এখন প্রতি মাসে যে টাকা পান, তার একটা অংশও ব্যয় করেন প্রতি শুক্রবার পড়তে আসা শিশুদের পেছনে। এ ছাড়া বিরাট ফলদ বাগান, পাঠাগার আর বিনোদন কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ তো আছেই। আর এ সবই করছেন নিজের উদ্যোগে।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামের মানুষ নাসির মাস্টারের এই উদ্যোগের নাম দিয়েছে জ্ঞানের বাগান!
আর তা হবেই বা না কেন? বাড়ির পাশের এক বিঘা জমিতে শিশুদের ফলের চাহিদা মেটাতে নাসির মাস্টার লাগিয়েছেন বিভিন্ন প্রকার ফলদ গাছ। এসব গাছের কোনো ফলই তিনি বিক্রি করেন না। যখন যে ফল হয় তা স্থানীয় শিশুদের মধ্যে বিতরণ করেন। শুধু তাই নয়, প্রতি শুক্রবারে শিশুদের লেখাপড়া শেখান। আর অন্যদিন বিকেলে শিশুরা আসে স্রেফ বিনোদনের জন্য।
এই বাগানটিতে রয়েছে হরেক রকমের ফুল-ফল আর ঔষধি গাছ। প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি এই বাগানের গাছের পরিচর্যা করে আসছেন বলে জানান নাসির মাস্টারের স্ত্রী মরিয়ম বেগম। এই বাগানে শিশুরা খেলা করে আর নানা ধরনের বই পড়ে। শিশুদের গাছের সাথে পরিচিত করতে কাগজে নাম লিখে লেমিনেটিং করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে প্রতিটি গাছের গায়ে। যাতে শিশুরা গাছ সহজে চিনতে পারে। এ ছাড়া গুণী মনীষীদের বাণী কাগজে লিখে লেমিনেটিং করে ঝুলিয়ে রেখেছেন গাছে গাছে।
দেশীয় নানা প্রজাতির পাখির সাথে শিশুদের পরিচিতি ঘটাতে বাগানের বড় গাছগুলোতে পাখিদের বাসা বানানোর জন্য হাঁড়ি ঝুলিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া বাগানের ভিতরের একটি জায়গায় পানি রেখে দেওয়া হয়েছে পাখিদের গোসলের জন্য।
প্রতিদিন বিকেলে শিশুরা ছুটে আসে এই স্থানে। তাদের জন্য এখানে রয়েছে দোলনাসহ নানা ধরনের খেলার সামগ্রী।
১৯৬৯ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন নাসির মাস্টার। ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণের পর নিজ হাতে গড়ে তোলেন শিশুদের জন্য বিনোদন কেন্দ্র ও পাঠাগার। শুধু তাই নয়, শিশুরা যেন বাংলা শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারে- এ জন্যে হরেক রকমের বাংলা শব্দের উচ্চারণ শেখানো হয় এখানে। এখানে শিশুরা যে শুধু পাঠ্য বই পড়ে- তা কিন্তু নয়। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি তাদের পড়ানো হয় নানা ধরনের শিশুতোষ গল্পের বই। নাসির মাস্টারের বাগানে বসে শিশুরা ছবিও আঁকে।
নাসির মাস্টারের লাইব্রেরিতে রয়েছে মনীষীদের জীবনীসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এসব তথ্যের ফাইলগুলো সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছেন তিনি। বসতবাড়ির একটি কক্ষে মায়ের নামে (কুলছুম নেছা পাঠাগার) একটি পাঠাগার স্থাপন করেছেন। পাঠাগারটিতে দেশীয় বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত গুণী ব্যক্তিদের তথ্য ও ছবির সমাহার।
১৯৪৬ সালে কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের কয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নাসির উদ্দিন। দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করার সময়ই তিনি নিজ গ্রামে শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য বন্ধুদের সাথে নিয়ে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে এলাকার বিভিন্ন বয়সের অশিক্ষিত মানুষকে মৌলিক বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো নাসির মাস্টার তার কাঁধে ঝোলানো লম্বা ফিতার ব্যাগের মধ্যে স্লেট এবং চক নিয়ে ঘুরে বেড়ান অশিক্ষিত মানুষের ঘরে ঘরে।
এ বিষয়ে নাসির মাস্টার বলেন, 'এসব কাজে আমি আনন্দ খুঁজে পাই। আর শিশুদের সাথে খেলাধুলা করতেও খুব পছন্দ করি। মূলত স্থানীয় শিশুদের মধ্যে শারীরিক, মানসিক ও মানবিক বিষয়গুলোর বিকাশ ঘটানোর জন্যই আমার এই উদ্যোগ। এই কাজে আমাকে সহযোগিতা করেন সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রকিবুল ইসলাম ও গ্রামের কিছু ব্যক্তি। এ কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যরাও সাধারণ মানুষের পাশে, গ্রামের শিশুদের পাশে দাঁড়াবে জীবনের শেষ সময়ে এসে- এটাই আমার প্রত্যাশা।'