‘টুসিকে হত্যা করা হয়েছে’

‘আর কোনো বাবাকে যেন এমন কষ্ট পেতে না হয়। আমার মেয়েটা আত্মহত্যা করতে পারে না। মেয়েটার শরীরে নির্যাতনের দাগ ছিল। টুসিকে হত্যা করা হয়েছে।’
আশরাফ বারীর কান্না থামছিল না। আজ রোববার সন্ধ্যায় সিরাজগঞ্জ থেকে মুঠোফোনে এনটিভি অনলাইনকে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিক। এখন আপনারাই পারেন ন্যায়বিচারের পথ দেখাতে।’
গত ৫ মে রাজধানীর পূর্ব তেজতুরী বাজার এলাকায় স্বামী শামস এলাহী উইলিয়ামের ফ্ল্যাট থেকে আশরাফ বারীর মেয়ে সোনিয়া আশরাফ টুসির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
২০০৯ সালে সিরাজগঞ্জ শহরের অধ্যক্ষ গাজীউর রহমানের ছেলে শামস এলাহী উইলিয়ামের সঙ্গে বিয়ে হয় টুসির। আশরাফ বারী বলেন, বিয়ের পর থেকেই টুসির স্বামী শামস, ননদ কুইন রহমান ও শাশুড়ি লাইলি রহমান নানাভাবে টুসির ওপর অত্যাচার করছিল। প্রেমের বিয়ের কারণে মেয়ে আমাদের কোনো কিছু বুঝতে দিত না।’
আশরাফ বারী জানান, টুসির শ্বশুরবাড়ীর লোকজন দাবি করে, টুসির ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কেউ টুসিকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেনি। খবর শুনে আমি যখন ঢাকার ওই বাসায় পৌঁছাই তখন বাজে সাড়ে ৩টা। এর আগেই পুলিশ টুসির লাশ হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যায়। এরপর ময়নাতদন্ত করে আমাকে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
আশরাফ বারী বলেন, ‘টুসির লাশ ধোওয়ানোর সময় শরীরে নির্যাতনের দাগ পাওয়া যায়। এ থেকেই বোঝা যায়, তাকে নির্যাতন করা হতো।’
এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে শামস এলাহী, কুইন রহমান ও লাইলি রহমানকে। তেজগাঁও থানা পুলিশ জানিয়েছে, আসামিরা পলাতক।
মামলার তদন্ত করছেন তেজগাঁও থানা উপপরিদর্শক সাইফুল বাশার। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ঘটনার দিন সাড়ে ৭টায় পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। এর আগে টুসির স্বামী শামস বাথরুমের দরজা ভেঙে টুসির লাশ বাইরে রাখে।’ তিনি আরো জানান, টুসির লাশের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এখনো পুলিশের হাতে এসে পৌঁছায়নি। তবে খুব শিগগিরই আমরা তা পেয়ে যাব।’
সাইফুল বাশার আরো বলেন, ‘প্রাথমিক লক্ষণে তো আত্মহত্যাই মনে হচ্ছে। তবে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
এ ব্যাপারে টুসির স্বামী শামস এলাহী উইলিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
নীরব হয়ে আছে টুসিদের বাড়ি
সিরাজগঞ্জ শহরে আমলাপাড়ায় টুসিদের বাড়ি। সামনে এক চিলতে উঠোনকে ঘিরে সাজানো ঘর। পুরো বাড়িটি এখন নীরব হয়ে আছে। টুসির মা সেলিনা আশরাফ এখন রাত-দিন কাঁদেন। আজ গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির এক প্রান্তে বসে তিনি কাঁদছেন। বাড়ির দেয়ালজুড়ে টুসির ছবি। এমনকি দেয়ালে ঝোলানো টুসির গায়ে হলুদ লেখা ককসিটটি এখনো জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে, কালই লাগানো হয়েছে। টুসির মা কথা বলতে পারছিলেন না। এক সময় বললেন, “ফোনে কথা হতো। আমি বলতাম, মা তুমি আশপাশের বাড়িতে যাও না। বলত, ‘না, যাই না। আশপাশের কেউ চেনেও না।’”
টুসির বাবা নীরব হয়ে আছেন ঘটনার পর থেকেই। খুব বেশি কথা না বলে কেবলই বলছেন, ‘আমার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।’ চোখের জল বন্ধ হচ্ছে না তাঁরও।
টুসির বাবা আশরাফ বারী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘গত ৫ মে ফার্মগেটের এত কাছের এলাকায় আমার মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হলো। অথচ টিভি, সংবাদপত্রে এ খবর পেলাম না। মেয়েটাকে হত্যা করা হলো। অথচ টিভি, খবরের কাগজে এ সংক্রান্ত কোনো লেখা বা ছবি আসেনি। এটা অস্বাভাবিক লেগেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘খবরটি কেন আসেনি গণমাধ্যমে তা আপনারা খতিয়ে দেখুন। অতীতে তো দেখলাম এ রকম অনেক ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে।’
ক্ষুব্ধ সিরাজগঞ্জ
সিরাজগঞ্জের মেয়ে টুসি হত্যার পর বিক্ষোভ করছে সিরাজগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ। টুসি ‘হত্যার প্রতিবাদে’ সিরাজগঞ্জে আজ রোববার মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন স্তরের মানুষ। সকালে স্থানীয় চৌরাস্তা এলাকায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে সচেতন সিরাজগঞ্জবাসী নামে একটি সংগঠন। কেবল সিরাজগঞ্জে নয় ঢাকাতেও ‘টুসি হত্যার’প্রতিবাদে বিক্ষোভ করবে বলে জানিয়েছেন মানববন্ধনে অংশ নেওয়া মানুষরা।
সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত এ মানববন্ধন কর্মসূচি চলাকালে বক্তব্য দেন, নিহত টুসির বাবা আশরাফ বারী, সিরাজগঞ্জ স্বার্থ রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা, আসাদ উদ্দিন পবলু, নব কুমার, নারী নেত্রী জলি ইয়াসমীন প্রমুখ।
এ সময় বক্তারা বলেন, টুসিকে নির্মমভাবে হত্যা করে মামলাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে একটি মহল। তাঁরা টুসির হত্যাকারী ঘাতক স্বামী শামস এলাহী উইলিয়াম, ননদ কুইন রহমান ও তাঁর শাশুড়ির ফাঁসি দাবি করেন। পরে প্রতিবাদকারীরা বিক্ষোভ মিছিল করে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি স্মারকলিপিও প্রদান করেন।
মানববন্ধনে নারী নেত্রী জলি ইয়াসমিন বলেন, ‘টুসির ক্ষত বিক্ষত মুখটা, কোথায় চোখ, কোথায় নাক, কোথায় মুখ বোঝার উপায় ছিল না। ভৌতিক একটা রং ছিল টুসির শরীরে। আমি স্বপ্নেও চিন্তা করি না কোনো মেয়ের যেন এমন হয়। কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।’
মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী সাংবাদিক শামীম ফিরোজী বলেন, ‘বিষয়টিতে সন্দেহ করার যথেষ্ট উপাদান আছে আমাদের কাছে। টুসির পরিবারের লোকদের সঙ্গে কথা বলে আমরা মনে করছি, টুসিকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ শুরু করেছি। সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এ প্রতিবাদ চলবে। আমরা রাজধানী ঢাকাতেও প্রতিবাদ করব।’