সবই মিলবে এই হাটে!

শতবর্ষ অতিক্রম করা মেরাদিয়া হাট নিয়ে নানা ধরনের কথা প্রচলিত আছে। বলা হয় এমন কিছু নেই যা এই হাটে পাওয়া যায় না। সুঁই থেকে হাতি সবই পাবেন এখানে। তবে হাতি না পাওয়া গেলেও সুঁই-সুতা পাবেন । ইঁদুর মারার বিষ থেকে শুরু করে ডিম-মুরগি, শুঁটকি থেকে তাজা মাছ, সবজি, ফলমূল, জামা-কাপড়, হাড়ি-পাতিল কী নেই?
ঢাকার আশপাশ এলাকা থেকে আসে হাটুরে-বিক্রেতারা। কেউ আসছে একদম নতুন কেউ বা ৫০-৬০ বছর ধরে আসেন এখানে। বুধবার বসে এই হাট। সূর্য উদয়ের পর থেকেই হাট বসতে শুরু করে। যারা প্রাতঃভ্রমণে বের হন তারাও বাড়ি ফেরার পথে ক্রেতা বনে যান। আর নিয়মিত ক্রেতারা তো আছেই।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা হাটুরে মজিবর জানান, তিনি ৫০-৬০ বছর ধরে এই হাটে আসেন। তার বাবাও আসতেন এখানে ব্যবসা করতে। এখন তিনি এখানে ছাতা ঠিক করে দেওয়ার কাজ করেন।
বুধবার সারাদিন মেরাদিয়া হাটে ঘুরে দেখা গেল বেঁচা বিক্রির নানা দৃশ্য। ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা রমজান মিয়া হাটে ঘুরে ঘুরে হ্যান্ড মাইকে ছড়ার সুর তুলে ইদুর মারার ওষুধ বিক্রি করতে করতে বলছিলেন, ‘ইঁদুর করে পারাপারি, নষ্ট করে বাসা বাড়ি, ওষুধ কেনেন তাড়াতাড়ি। ইঁদুর তোমার রেহাই নাই, ধরা পরলে জামিন নাই, ময়নার মার ঘুম নাই...’ । এর মাঝেই এক ক্রেতার দেখা পান। শুরু হলো তাঁদের দরদাম।
একটু এগিয়ে যেতেই দেখা গেল জিলাপি ভাজছেন এক ময়রা। জানালেন হাটুরেরা কিনে খায়। অনেক ক্রেতাও কিনে নেয়। তবে তার প্রধান খদ্দের হাটে আসা হাটুরেরা।
এই হাট যখন শুরু হয়েছিল তখন বড় একটি বটগাছ পুকুর ঘিরে এর চারপাশে খোলা মাঠজুড়ে বসত হাট। এখন সেই চিত্রপট বদলে গেছে। হাট বসছে রাস্তার পাশে ছোট ছোট খোলা জায়গায়। যা এখন ব্যক্তি মালিকানা প্লট। অনেক স্থানে ভবন নির্মাণ হচ্ছে আবার কোনো কোনো জায়গা ভবন নির্মাণের অপেক্ষায় আছে এই প্লটগুলো। জায়গা কমে আসায় হাট এখন ছড়িয়ে গেছে এই স্থানজুড়ে চারদিকে। রামপুরা থানার সামনের গলিসহ আশপাশের গলির ভেতরও বসছে হাট।
হাটের পূর্ব দিকে বসে মাছ ও সবজি বিক্রেতারা। ফল বিক্রেতারাও বসেন এর আশপাশ ঘিরেই। তাদের পরেই বাঁশ বিক্রেতা। যদিও এই ‘বাঁশপট্টি’ সবসময়ই বসে।
ফল বিক্রির স্থানে গিয়ে দেখা পাবেন বিভিন্ন মৌসুমি ফলের। কলা, পেঁপে থেকে শুরু করে ডাব, বেল, কামরাঙ্গা, পানিফল, ডেউয়াসহ নানা ধরনের দেশীয় ফল। রামপুরা থানার পাশের গলিতেই বসে হাঁস, পাখি, কবুতর, খরগোশ ইত্যাদি পোষ্য পশু-পাখি বিক্রেতারা।
হাটে ঘুরতে ঘুরতে দেখা মিলবে, জামা-কাপড়, বিছানার চাদর, মাটি ও কাচের জিনিসপত্র বিক্রেতাদের। বসছে বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ বিক্রেতারাও।
হাটে মুখরোচক খাবার নিয়ে বসেন মোহম্মদ শরিফ। তিনি বলেন, ‘১৬ বছর ধরে এই হাটে আসি আমি। ডিমের চপ, ফুসকা পুরি, পেঁয়াজু এগুলো বিক্রি করি। সবাই বেশ পছন্দ করে।’
হাঁস-মুরগি বিক্রেতা শাহজাহানের সাথে কথা বলতে যেতেই তিনি বলেন, ‘মামা পত্রিকায় দিবেন? লেখেন আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে হাঁস মুরগি কিনে এনে বিক্রি করি। এখানে ময়মনসিংহ, বগুড়া আরো অনেক এলাকা থেকে হাঁস-মুরগি কিনে এনে বিক্রি করি।’
কথা হয় ক্রেতা সবুজের সাথে। বলেন, ‘নিয়মিত আসি এই হাটে। তবে খুব বেশি ভিড় হয়। হাঁটা-চলাই মুশকিল। দিনদিন জায়গার সংকটে এখন অনেক বেশি ঝঞ্জা পোহাতে হয় আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে। আর রাস্তায়ও প্রচুর জ্যাম লেগে যায়।’
স্থানীয়রা ছাড়াও আশপাশের এলাকা থেকে আসে ক্রেতারা। দুপুরের পর নারীদের ভিড় বেশি হতে থাকে। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত যেন নারীদের দখলে থাকে হাট। বাজার ঘুরে ঘুরে দরদাম করে কিনে নেন যে যার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বিশেষ করে কাপড় বিক্রির স্থানে নারীদের আনাগোনা বেশি লক্ষণীয়। একই সঙ্গে করে নেন সাপ্তাহিক বাজার।
সন্ধ্যার আগে আগে হাটের আশপাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলে চোখে পড়বে কেনাকাটা করে ফিরছেন ক্রেতারা। রাত ১০টার সময় এলেও চোখ পড়বে কুপি বাতি জ্বালিয়ে তখনো কিছু হাটুরে আছেন ক্রেতার অপেক্ষায়। আর কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে অনেকে সেই রাতেও ঢুঁ মারেন একবার। হয়তো তার প্রয়োজনীয় জিনিসটা খুঁজতেই ফিরতি পথে নেমে পড়েন হাটে। আর শেষ ক্রেতার জন্য তখনো কিছু হাটুরে অপেক্ষা করেন।