নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আকাঙ্খার এবারের একুশে বইমেলা
বাংলাদেশে একদিন পর পর্দা উঠবে অমর একুশে গ্রন্থমেলার। নতুন পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠেয় এ মেলার মূল থিম জুলাই গণঅভ্যুত্থান : ‘নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ'।
অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম বইমেলাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১৯৫২-র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের নামে সেই ভাগগুলো। মেলার বিশেষ আকর্ষণ থাকছে ‘জুলাই চত্বর’, সেখানে গণঅভ্যুত্থানের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হবে। মেলার রঙ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে লাল, কালো ও সাদা। লাল বিপ্লবের প্রতীক, কালো শোকের এবং সাদা আশার।
এবারের বইমেলা স্টল আর প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার মেলার আকার বেড়েছে। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ড. সরকার আমিন বলেন, ‘‘এবারের বইমেলায় মোট ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে এক হাজার ৮৪ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছর প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৪২টি এবং ইউনিট ছিল ৯৪৬টি।”
প্রশ্ন করা হলে সরকার আমিন জানান, ‘৫২-র ভাষা আন্দোলন এবং ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান থাকলেও বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ঐতিহাসিক মাইলফলক, অর্থাৎ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনো চত্বর মেলায় নেই। না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের কারণে এবার ‘জুলাই চত্বর' রাখা হয়েছে। ভাষা শহীদদের নামেও আছে। তবে আগে কখনো বই মেলায় মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চত্বর ছিল না বা করা হয়নি, সেই কারণে এবারও রাখা হয়নি।”
এরমধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এবার মোট প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি, যার মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি। গত বছরও (২০২৪) প্যাভিলিয়ন ৩৭টি ছিল।
এবার লিটল ম্যাগাজিন চত্বর করা হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছের গাছতলায়। সেখানে ১৩০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শিশুচত্বরে ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১২০ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছর শিশুচত্বরে ৬৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১০৯টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
গত বছর ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে বইমেলায়। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৭৫১টি। এবার আরো বেশি বই প্রকাশের আশা করা হচ্ছে। মেলায় এবার মোড়ক উন্মোচন হয়েছে ৬০০টি বইয়ের। গত বছর দর্শনার্থীর সংখ্যা ৬০ লাখের কাছাকাছি ছিল, এবার সেই সংখ্যাও ছাড়িয়ে যেতে পারে৷
ড. সরকার আমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার বইমেলা নিয়ে আমরা অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত, আশাবাদী। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে, স্টল বেড়েছে, মেলার আয়তন বেড়েছে। আশা করি নতুন বইও বেশি আসবে। এবার একটা পরিবর্তনের আকাঙ্খা আছে মানুষের মধ্যে। সেই আকাঙ্খাকে ধারণ করেই এবারের বইমেলা। আশা করি এবার উৎসবে মানুষের ঢল নামবে। প্রকাশনা আর সাহিত্যে লাগবে পরিবর্তনের ছোঁয়া। আমরা অনেক বেশি আশাবাদী। আমরা নিরাপত্তাসহ সব দিক দিয়েই মেলা সুন্দর করার চেষ্টা করছি। পুরো মেলা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে।”
সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে-কোনো সময় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বইমেলা চলাকালীন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের জন্য একাডেমি ও প্রকাশক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ‘শৃঙ্খলা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
মেলার নীতিমালায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানবিরোধী, যে-কোনো জাতিসত্তাবিরোধী, অশ্লীল, রুচিগর্হিত, শিষ্টাচারবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন বা জননিরাপত্তার জন্য বা অন্য কোনো কারণে বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর কোনো বই বা পত্রিকা বা দ্রব্য অমর একুশে বইমেলায় বিক্রি, প্রচার ও প্রদর্শনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে একাডেমি।
কবি রওশন আর মুক্তা বলেন, ‘‘সহিত্যের কোনো মান বেঁধে দেওয়া যায় না। আর কোনো নীতিমালা দিয়ে সাহিত্যের মানও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তবে এডিটোরিয়াল দিক দিয়ে প্রকাশনায় মান ও দক্ষতা থাকা উচিত। আমার নিজের কবিতায় এবার গণঅভ্যুত্থানের প্রভাব আছে। হয়তো আরো অনেকের সাহিত্যে থাকবে। আশা করছি বেশি প্রকাশক আর স্টল বইয়ের প্রকাশনাকেও বাড়িয়ে দেবে, নতুন লেখক বাড়বে।”
“দামের কারণে কেউ যে তার প্রিয় বা পছন্দের বই কিনবে না, তা মনে করি না। তবে প্রকাশনার খরচ বেড়ে যাওয়া একটা চাপ। এবারে সেই চাপ থাকবে”, বলেন তিনি।
নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য ‘নতুন বই উন্মোচন মঞ্চ’ নামে একটি নির্দিষ্ট স্থানের ব্যবস্থা থাকবে। একটি ‘লেখক বলছি মঞ্চ’ থাকবে। সেখানে প্রতিদিন নতুন বই সম্পর্কে লেখক-পাঠক-দর্শকের মধ্যে আলোচনা, মতবিনিময়, প্রশ্নোত্তর পর্ব চলবে। আগের বছরে প্রকাশিত ‘বিষয় ও গুণগত মানসম্মত’ সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ‘শৈল্পিক বিচার’-এ সেরা গ্রন্থের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে ‘গুণগতমান বিচার’-এ সর্বাধিক বইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের ‘নান্দনিক অঙ্গসজ্জা’য় সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে তিন ক্যাটাগরিতে ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে।
সময় প্রকাশনের কর্ণধার ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘‘মেলায় স্টল বেড়েছে। অনেক নতুন নতুন প্রকাশনা সংস্থাকে স্টল দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই প্রকৃত প্রকাশক কিনা তা আসলে বইমেলায় প্রকাশিত বই দেখলে বোঝা যাবে। তারা যদি প্রকাশক না হয়ে থাকে, তাহলে তো নানা প্রশ্ন উঠবে। আর স্টল বাড়াতে গিয়ে মেলা ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। এটা বই মেলার জন্য ভালো কিনা, বইপ্রেমীদের জন্য স্বস্তিদায়ক কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।”
ফরিদ আহমেদ আরও বলেন, ‘‘প্রকাশনার খরচ বাড়লেও আমাদের দাম বাড়ানোর সুযোগ কম। কারণ, দাম এমন পর্যায়ে গেছে যে আর দাম বাড়ালে পাঠকের নাগালের বাইরে চলে যাবে। আমরা বাধ্য হয়ে তাই প্রফিট মার্জিন কমিয়ে দিচ্ছি।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে ফরিদ আহমেদ বলেন, “সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে হঠাৎ করে সাহিত্য হয় না। ফলে ৫ আগস্টের প্রভাব তেমন এবারের প্রকাশনায় পড়বে বলে মনে হয় না। কিছু বই হয়তো বের হবে। আমার দিক থেকে আমি এবার মেলায় তেমন নতুন কিছু দেখছি না। যা দেখছি তাকে গতানুগতিকই বলবো।”
১ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করবেন। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা এবং ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বইমেলা উন্মুক্ত থাকবে। শুধু একুশে ফেব্রয়ারি সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বইমেলা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলার আয়োজনে থাকবে শিশুদের আয়োজন ‘শিশু প্রহর’। বিগত বছরগুলোর মেলার মতো এবারও বাংলা একাডেমিসহ অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে।