পাণ্ডুলিপি যাচাইয়ের প্রস্তাব বনাম লেখক-প্রকাশকের স্বাধীনতা
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার চান অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমি আগে দেখে দিক। শুধু তাই নয়, যাচাইয়ের জন্য আরেক পুলিশ কর্মকর্তা বই পড়েও দেখতে চান।
পুলিশের এই কথায় লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা এই প্রচেষ্টাকে লেখকের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তৎপরতা বলে মনে করছেন। আর সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারকী ওই প্রস্তাবকে ‘হাস্যকর’ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলা একাডেমি বলেছে, তাদের মধ্যে পাণ্ডুলিপি দেখার কোনো চিন্তাই নাই।
শুক্রবার পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এর আগে বইমেলায় কনটেন্ট নিয়ে সমস্যা হয়েছে। বাংলা একাডেমি যেন স্ক্যানিং করে। তারপর ভেটিং স্টলে উপস্থাপন করেন। তারা আগে পাণ্ডুলিপিও পড়ে দেখতে পারেন। এটা বইমেলা ছাড়া সারা বছরের জন্যও হতে পারে। আশা করি ২০২৬ সালের বইমেলায় এটা হবে।’
তার সঙ্গে থাকা অতিরিক্ত কমিশনার এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, “আমরা এবার বাংলা একাডেমিকে সাজেস্ট করছি আগামীতে নতুন যে বইগুলো প্রকাশিত হবে তার পাণ্ডুলিপি আগেই যেন বাংলা একাডেমিতে জমা দেওয়া হয়। তারা এটা যাচাই-বাছাই করবে পড়ে দেখবে যে এমন কোনো বিষয়বস্তু না হয়, যেটা আমাদের সোশ্যাল লাইফকে ডিজরাপ্ট করে আমাদের কমিউনাল হারমোমোনিকে ডিজরাপ্ট করে, আমাদের দেশদ্রোহী কোনো বক্তব্য বা প্রকাশনা বা সরকারকে ডিস্টাবিলাইজ করে-এ রকম কোনো ধরনের প্রকাশনা যেন মেলায় না আসে।”
লেখক প্রকাশকদের প্রতিক্রিয়া
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক পুলিশের ওই কথার জবাবে বলেন, “আমি এটাকে কনটেক্সট না বুঝে কাণ্ডজ্ঞানহীন একটা উক্তি মনে করি। আমার মনে হয় উনি ছাড়া অতীতে এই কথা আর কেউ বলেনি। আগে একটা রুল ছিল নাটক মঞ্চস্থ করার আগে পুলিশকে দেখিয়ে নিতে হবে। ওটা ছিল ব্রিটিশ আমলের। নাট্যকর্মীরা আন্দোলন করে সেটা বাতিল করিয়েছেন।”
“এই ধরনের কথা লেখকের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। আমার মনে হয় এই লোকগুলোর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকার সম্পর্কে কোনো ধারণা নাই। তারা মাইক্রোফোন দেখলেই কথা বলতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন,” বলেন তিনি।
লেখক রাখাল রাহা মনে করেন, “না বুঝেই হুট করে পুলিশ কর্মকর্তা একটি কথা বলে দিয়েছেন। সঠিক জ্ঞান না থাকলে এটা হতে পারে। আর যদি তিনি লেখক বা প্রকাশনার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে বলে থাকেন, তাহলে এটা অনধিকার চর্চা। লেখকের স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তার ওপরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
আরেকজন লেখক ও গবেষক আজহার ফরহাদ বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা পুলিশ কর্মকর্তা এধরনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি বা নেননি। ওই পুলিশ কর্মকর্তারা যা বলেছেন তা ন্যক্কারজনক। এতবড় একটা পটপরিবর্তনের পর তারা এধরনের কথা বলেন কীভাবে! এই ধরনের কথা লেখকের স্বাধীনতা, প্রকাশকের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকিস্বরূপ।”
প্রকাশনা সংস্থা অন্য প্রকাশ এর কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম বলেন, “প্রথমত, এটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী। দ্বিতীয়, পৃথিবীর কোথাও এভাবে বই প্রকাশ হয় কিনা আমার জানা নাই। আর তৃতীয়ত, এটা বাস্তবসম্মত নয়।”
এক প্রশ্নের জবাবে মাজহারুল ইসলাম বলেন, “আমার মনে হয় পুলিশ কর্মকতারা এটা যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী এবং বাস্তবসম্মত নয়, সেটা না বুঝেই বলে ফেলেছেন। তাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না।”
বাংলা একাডেমির বইমেলার নীতিমালায় বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানবিরোধী, যেকোনো জাতিসত্তাবিরোধী, অশ্লীল, রুচিগর্হিত, শিষ্টাচারবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন বা জননিরাপত্তার জন্য বা অন্য কোনো কারণে বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর কোনো বই বা পত্রিকা বা দ্রব্য অমর একুশে বইমেলায় বিক্রয়, প্রচার ও প্রদর্শনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে একাডেমি।”
এই নীতিমালা নিয়েও সমালোচনা আছে। লেখক আনিসুল হক বলেন, “আসলে অশ্লীল, রুচিগর্হিত, শিষ্টাচারবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে- এগুলোর ধারণা স্পষ্ট নয়। ফলে এর অপব্যবহার হতে পারে। এই ধারণাগুলো একেকজনের কাছে একেক রকম। আর ধারণা পরিবর্তনও হয়। তবে আমি মনে করি প্রকাশকের দিক থেকে তাদের ভালো সম্পাদনা পর্ষদ থাকা দরকার। সেটা লেখকের লেখা পরিবর্তনের জন্য নয়। ভালো বই উপহার দেওয়ার জন্য।”
আনিসুল হক আরও বলেন, “এক সময় বিলেতে টেবিলের পায়া ঢেকে না রাখাও অশ্লীলতা বলে গণ্য হতে। জীবনানন্দ দাশের ‘ক্যাম্পে’ কবিতা, বুদ্ধদেব বসুর ‘ডাকঘরে বৃষ্টি’ নিয়ে অশ্লীলতা বিতর্ক হয়েছে। বাংলা একাডেমি একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার নীতিমালা থাকতে পারে। কিন্তু লেখক হিসেবে আমার স্বাধীনতা অনিঃশেষ।”
প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম বলেন, “বাংলা একাডেমির ওই নীতিমালা আসলে প্রয়োগ করা হয় না। তবে এধরনের কোনো নীতিমালা থাকার দরকার আছে বলে মনে হয় না। আমরা সবাই সংবিধান মেনে চললেই হবে।”
সংস্কৃতি উপদেষ্টা বললেন ‘ভুল বোঝাবুঝি’
একদিন পর শনিবার ঢাকায় জাতীয় কবিতা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুলিশের ওই কথার প্রতিক্রিয়ায় সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “গণমাধ্যমে একটা সংবাদ ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করছে। পুলিশের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, বই ছাপানোর আগে বাংলা একাডেমি বা পুলিশকে পড়তে দেওয়া উচিত। এটা অবিশ্বাস্য, এটা হাস্যকর। আমাদের সরকারের নীতিমালার আশপাশেই নেই।”
সংস্কৃতি উপদেষ্টা আরও বলেন, “সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। সেটা যদি আমাকে গালাগালি করেও হয়, এতে কিছু যায় আসে না। আর বই প্রকাশ সেন্সর করবো, এটা হাস্যকর। এই ভুল বোঝাবুঝি এখানেই দূর করতে চাই। অন্তর্বর্তী সরকারের বই সেন্সরের পরিকল্পনা নেই। ওই পুলিশ কর্মকর্তা যদি বলে থাকেন, সেটা তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনার কথা বলেছেন। এটার সঙ্গে আমরা একমত নই।”
ব্যাপক সমালোচনার মুখে ডিএমপি এই ইস্যুতে একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ৩১ জানুয়ারি ব্রিফিংয়ে উপস্থিত এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে বা কোন উসকানিমূলক বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ করা হয়। ইতোপূর্বে বইমেলা আয়োজনে প্রস্তুতিমূলক সভায় উপস্থিত বিভিন্ন অংশীজনের সাথে আলোচনায় অনেকে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। প্রকাশিতব্য বইসমূহ আগামীতে পুলিশ কর্তৃক ভেটিং বা অনুমোদন সংক্রান্ত কোন পরার্মশ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি বা বলা হয়নি।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ, লেখনীর মত সৃজনশীল কর্মকাণ্ডকে আমরা সবসময় উৎসাহিত করি। মুক্ত মনের চর্চা ও বিকাশের পরিবেশকে আমরা স্বাগত জানাই।”
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. সরকার আমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বইয়ের পাণ্ডুলিপি আগে দেখে দেওয়া বা পুলিশ কর্মকর্তারা যা বলেছেন তা নিয়ে বাংলা একাডেমির কোনো পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত নেই। কোনো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমরা কোনো নির্দেশও পাইনি।”
তিনি এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি।