শেখ হাসিনার ‘মিথ্যা বক্তব্য’ প্রদানে ভারতের বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত

যতক্ষণ না শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, অন্তত তার উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ও মিথ্যা বক্তব্য প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে ভারত, এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। গত সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি।
গত রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ওমানের রাজধানী মাসকাটে অষ্টম ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের (ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স) ফাঁকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সাক্ষাৎ হয়। সেখানে আলোচনায় দুই দেশের সম্পর্কে যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, সেগুলোর সমাধানে একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সাক্ষাতের পরদিন দ্য হিন্দুকে এই সাক্ষাৎকার দেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। নিচে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-
দ্য হিন্দু: সম্পর্কে উত্তেজনার মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ সম্পর্কে আমাদের বলুন।
তৌহিদ হোসেন: খোলাখুলি বললে, আমি যেমনটি দেখেছি, শুরুটা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। কারণ, ভারত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে সম্পর্কের একটি ধরনে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তা ভেঙে পড়ে। হয়তো নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কিছুটা সময় লেগেছে। সে কারণে সম্পর্কে অনেক বৈরী মনোভাব এবং অস্বস্তি অবশ্যই ছিল। কিন্তু আমার মনে হয়, ছয় মাস আগের তুলনায় অবশ্যই আমরা একে অপরের সঙ্গে অনেক ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পারি।
দ্য হিন্দু: সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ওয়াশিংটন সফর করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, সেখানে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের কিছু উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আপনি কি জয়শঙ্করের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলাপ করেছেন?
তৌহিদ হোসেন: আসলে জিজ্ঞাসা করিনি। কারণ এটা ভারতের ব্যাপার। আমার মনে হয় না খুব বেশি উদ্বেগ থাকা উচিত। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত, যা ইতিমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে ঘটছে। উদাহরণ হিসেবে বাণিজ্যের কথা বলা যায়। বাণিজ্যে অল্প সময়ের জন্য মন্দা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু আবার তা চাঙা হয়ে উঠেছে।
দ্য হিন্দু: ভারত বারবার বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আপনি কি মনে করেন যে আপনার সরকার এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে?
তৌহিদ হোসেন: বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দু বা অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলিম বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মতোই সমান নাগরিক। তারা সম-অধিকার এবং একই রকম সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারসম্পন্ন নাগরিক। দুর্ভাগ্যবশত, ৫ আগস্টের ঠিক পরে ভারতীয় মিডিয়ায় এই বিষয়টি নিয়ে প্রায় ব্যাখ্যাতীত উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়। যার বেশির ভাগই মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে।
আমি আপনাকে দুই দিন আগে প্রকাশিত জাতিসংঘের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যগুলো পড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
দ্য হিন্দু: আমি জাতিসংঘের কমিটির প্রতিবেদনটি পড়েছি। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আপনার সরকার কি কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে?
তৌহিদ হোসেন: অবশ্যই। এমনকি জাতিসংঘের প্রতিবেদনের আগেই আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। এটা বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব এবং সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমি মনে করি না এই বিষয়ে কথা বলা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জন্য সঠিক। এটি সম্পূর্ণরূপে একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশ সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের উপদেষ্টা পরিষদে কমপক্ষে চারজন সদস্য আছেন, যারা মানবাধিকারকর্মী এবং তারা বহু বছর ধরে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে আসছেন। তারা নিজেরাই সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন।
দ্য হিন্দু: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে, ভারত কী করবে বলে আপনারা আসলে আশা করছেন?
তৌহিদ হোসেন: তার (শেখ হাসিনা) বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে এবং বিচারের মুখোমুখি করতে তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য আমরা ভারতকে বলেছি। যতক্ষণ না ভারত সরকার সেটা করছে, আমরা আশা করব, তারা অন্তত তার ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, যাতে তিনি এমন কোনো উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ও মিথ্যা বক্তব্য না দেন, যেটা মানুষকে উসকে দেওয়ার মতো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। কারণ, বিষয়গুলো এখনও খুবই তরতাজা। ১৫ বছর ধরে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন এবং মানুষ তার কর্মকাণ্ড নিয়ে তীব্রভাবে ক্ষুব্ধ। তাই তারা দেখতে চান যে তিনি যেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা না করেন।
দ্য হিন্দু: শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে আপনার সরকার এখন পর্যন্ত কেবল একটি কূটনৈতিক নোট পাঠিয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে কি প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানো হবে?
তৌহিদ হোসেন: আমাদের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে। আমরা অনেক অভিযুক্তকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ভারতকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি মনে করি, ভারত তাঁকে বাংলাদেশে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ফিরিয়ে দিতে পারে।
দ্য হিন্দু: কিন্তু সেই প্রত্যর্পণ চুক্তির জন্য পর্যাপ্ত ওয়ারেন্ট থাকতে হবে। বাংলাদেশ কখন এই প্রক্রিয়া শুরু করার আশা করছে?
তৌহিদ হোসেন: আচ্ছা, প্রক্রিয়াটি ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। কারণ, মামলাগুলো এখন আদালতে।
দ্য হিন্দু: বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। জেলেদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া কিছু জেলের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাদের মারধর করা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে?
তৌহিদ হোসেন: আমি তেমনটি মনে করি না। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে সীমান্ত। ২০২৪ সালে সীমান্তে ২৪ জনকে গুলি করা হয়েছে, যার অর্ধেক বিগত সরকারের আমলে। বিশ্বের আর কোথাও এটা হয়নি। আমি মনে করি, আপনি আমার সঙ্গে এই বিষয়ে একমত হবেন। কারণ, ভারতীয় পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়, যেহেতু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়, সে কারণে এটা ঘটছে। বিশ্বের প্রতিটি সীমান্তেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়, কিন্তু কোথাও মানুষকে এভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় না। যদি অপরাধ ঘটে, আপনি তাদেরকে গ্রেপ্তার করুন এবং আদালতে নিয়ে যান। কারাদণ্ড হোক বা আদালত যেকোনো রায় দিতে পারেন। কিন্তু আপনি তাকে হত্যা করতে পারেন না। সেখানে সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন সরকারের সময়ে কী ঘটছে। এটা এখনও বন্ধ হয়নি। এটা এমন একটি বিষয়, আমি মনে করি, ভারত যদি চায় থামাতে পারে এবং এটা বন্ধ করা উচিত। অন্য বিষয়গুলো সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত।
দ্য হিন্দু: বাংলাদেশ ও ভারত কয়েক বছর আগে একটি সমুদ্র চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এখনও একে অন্য দেশের জেলেদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
তৌহিদ হোসেন: আমি ঘটনাস্থলে যাইনি। তবে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে, আপনি জানেন জেলেরা মাছের দলকে অনুসরণ করেন। স্থলভাগে আপনার একটি নির্দিষ্ট সীমানা থাকে, আপনি জানেন যে এটাই সীমা। কিন্তু সমুদ্রে, এটা এত সহজ নয়। প্রায়ই উভয় দেশের জেলেরা পরস্পরের সামুদ্রিক অঞ্চলে প্রবেশ করে। আমাদের কিছু জেলে ভারতের হেফাজতে রয়েছে। আবার ভারতের কিছু জেলে আমাদের হেফাজতে রয়েছে। আমরা উভয় দেশই নির্দিষ্ট সময় পর তাদের মুক্ত করে দিই। খারাপ আচরণ করার বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যেই তদন্ত করতে বলেছি।
দ্য হিন্দু: বাংলাদেশ সরকার আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ পেতে আলোচনা করছে। আপনি কি নিশ্চিত করতে পারবেন যে, বাংলাদেশ সরকার আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তিটি অব্যাহত রাখতে চায়?
তৌহিদ হোসেন : আমি কোনও টেকনিশিয়ান, টেকনিক্যাল ব্যক্তি নই। তাই আমি সঠিকভাবে বিশদ বলতে পারছি না। তবে অন্যান্য চুক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, বিদ্যুতের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি। তাই আমরা বিশ্বাস করি যে, এটি নিয়ে আবারও সমঝোতা আলোচনা করা উচিত, বিশেষ করে কয়লা কেনার প্রশ্নে। যেকোনো যৌক্তিক ব্যক্তিই বলবেন যে, বিশ্ববাজারে সম্ভাব্য সর্বোত্তম দামে এই প্রকল্পের জন্য কয়লা কেনা উচিত। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
আপাতত আমরা বিদ্যুৎ দিতে অনুরোধ করেছি। তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করুক এবং তারপর আমরা এর জন্য অর্থ প্রদান করব।
দ্য হিন্দু: আপনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দুবার সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে এখনও সাক্ষাৎ হয়নি। আপনি কি এপ্রিলে থাইল্যান্ডে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে তাদের মধ্যে একটি বৈঠকের আশা করছেন?
তৌহিদ হোসেন: এখন পর্যন্ত দুই নেতা একই দিনে কোনো একটি জায়গায় ছিলেন না, তাই তাদের সাক্ষাতের কোনো সুযোগ হয়নি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে, উভয়পক্ষেরই সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা এবং মুক্ত মনে ও খোলামেলাভাবে আলোচনা করার আগ্রহ আছে। এটা সহায়ক হয়। এই সরকারের শুরুতে তারা একবার টেলিফোনে কথা বলেছেন। বিমসটেকে তারা একই অনুষ্ঠানস্থলে থাকবেন। আমার জানা মতে, অন্যান্য দেশের সরকারপ্রধানেরাও থাকবেন। যদি তারা সেখানে থাকেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবেন।
দ্য হিন্দু: আপনি কি এ নিয়ে জয়শঙ্করের সঙ্গে কথা বলেছেন?
তৌহিদ হোসেন: এটা এখনও তেমন পর্যায়ে যায়নি। কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়ে গেলে আমরা এই বিষয়গুলি ঠিক করি। দেখা যাক কী হয়।
দ্য হিন্দু: আপনি কি মনে করেন, ২০০৯ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল, ভারত ও বাংলাদেশ আবার সম্পর্কের সেই অবস্থায় ফিরে আসতে পারে?
তৌহিদ হোসেন: আমরা শুধু গত ১৫ বছর কেনো দেখব? এমনকি বিএনপির আমলেও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমার মনে হয় না, সম্পর্ক নির্দিষ্ট সরকারকেন্দ্রিক হতে হবে। ১৯৯৬-১৯৯৭ এ আমাদের গঙ্গা চুক্তি হয়েছিল। তাই আমি মনে করি, আমাদের দুই দেশের রাজধানীতে যে সরকারই হোক, যে দলই ক্ষমতায় থাক না কেন, তা আমাদের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলা উচিত নয়। কারণ সম্পর্ক পারস্পরিক স্বার্থ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর নির্ভরশীল।