ঝিনাইদহে যে গ্রামে ৬ দশক ধরে তৈরি হয়ে আসছে আখের গুড়

ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার খন্দকবাড়িয়া গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিরাট কর্মযজ্ঞের। চলছে গুড় তৈরি। গুড় তৈরির জন্য সড়কের পাশেই স্তূপ করে রাখা হয়েছে আখ। পাশেই যন্ত্রের সাহায্যে আখ থেকে বের করা হচ্ছে রস। এরপর সেই রস চুলার পাশে কাপড়ের মাধ্যমে ছেঁকে চাড়িতে রাখা হচ্ছে।
একদিকে পাশাপাশি জ্বলছে ছয়টি চুলা। চুলার ওপর টগবগ করে ফুটছে আখের রস। রস লাল হয়ে এলে এক চুলা থেকে চলে যাচ্ছে আরেক চুলায়। জ্বালানো শেষে তা টিনের পাত্রে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানে। এরপর সেখানে রাখা মাটির পাত্রে ঢেলে তা ঠান্ডা করা হচ্ছে। ঠান্ডা হয়ে গেলেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে সুস্বাদু আখের গুড়।
এ চিত্র শৈলকুপার অজপাড়াগাঁয়ের এক কারখানার। প্রায় ৬০ বছর ধরে এই আখের গুড় তৈরির কারাখানায় তৈরি হয়ে আসছে ভেজালমুক্ত গুড়। খন্দকবাড়িয়া গ্রামের দুই ভাই রেজাউল ইসলাম ও মিজানুর রহমান কারখানাটির বর্তমান মালিক। তারা নিজেরাই গুড় তৈরি করেন।
আগে জেলার অনেক বাড়িতে দেখা মিলত এই গুড় তৈরির কারখানার। কিন্তু এখন তা বিলুপ্তির পথে। তবে বাবার হাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্মৃতি হিসেবে এই কারখানাটি আকড়ে ধরে রেখেছেন দুই সহোদর। এই কারখানাটির গুড় পিঠা-পায়েস, সেমাই-সুজিসহ স্থানীয়দের মিষ্টিজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরির চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলাতেও যায়।
আখচাষিরা বলছেন, আখের দাম কম হওয়ায় তা বাইরে বিক্রি না করে এই কারখানায় এনে গুড় তৈরি করেন তারা। তাতে নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও কিছুটা বিক্রিও করতে পারেন।
কারখানার মালিক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার বাবা আখের চাষ করতেন। সে সময় অনেকে নিজ নিজ বাড়িতে রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করে বিক্রি করতেন। ১৯৬৫ সালে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে মোবারকগঞ্জ চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের বাড়ি থেকে ওই চিনিকলের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। তার দু-তিন বছর আগেই কারখানা তৈরি করে আমার বাবা বাড়িতে গুড় তৈরি শুরু করেন।’
মিজানুর রহমান বলেন, ‘আগে গরু দিয়ে আখ মাড়াইয়ের কল চালানো হতো। এখন শ্যালো মেশিনের ফিতা চালিয়ে রস বের করা হয়। এরপর মাটির চুলায় রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করা যায়। এক প্রান্তে মাড়াইয়ের যন্ত্র, আরেক প্রান্তে গুড় তৈরির চুলা। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য চুলাগুলো একটি চালার নিচে করা হয়েছে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এ কারখানায় গুড় তৈরি করা হয়। প্রতি ১০ কেজি আখ থেকে ১ কেজি গুড় পাওয়া যায়। আগে মাসে প্রায় ৪০০ কেজি গুড় তৈরি করলেও এখন তা অনেক কমে এসেছে।
রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে আখ কিনে আমরা গুড় তৈরি করি। পরে সে গুড় বাজারে বিক্রি করা হয়। আবার অনেকে আখ নিয়ে এসে গুড় তৈরি করে নিয়ে যান। পুরাতন ঐতিহ্য ধরে রাখতেই এ পেশা ধরে রেখেছি আমরা। এ বছর ৩০ মণ গুড় উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে। আর প্রতি কেজি বিক্রি হবে ২০০ টাকা কেজি দরে।’
শৈলকুপা উপজেলা কৃষি অফিসের অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা আবুল হাসনাত বলেন, ‘নিরাপদ আখের গুড় উৎপাদন করতে তাদের সবরকম সহযোগিতা করা হচ্ছে।’