জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের আপিলের রায় ২৭ মে
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিলে উভয়পক্ষের শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ২৭ মে রায়ের জন্য দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ।
বৃহস্পতিবার (৮ মে) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানি শেষে রায়ের এ দিন ধার্য করেন।
দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে অংশ নেন এটিএম আজহারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনিক আর হক।
সাক্ষীদের ত্রুটিপূর্ণ সাক্ষ্য উপস্থাপন করে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, একজন সাক্ষী বলেছেন, তিন মাইল দূর থেকে তিনি দেখেছেন নির্যাতন করতে। একজন সাক্ষী বলেছেন, এটিএম আজহার ডান হাত দিয়ে ভিকটিমের বাম গালে থাপ্পড় মারেন। সামনি সামনি থেকে থাপ্পড় দিলে তো বাম গালে লাগার কথা৷ মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে রাজনৈতিকভাবে, পরিকল্পিতভাবে এটিএম আজহারকে জড়ানো হয়েছে।
শুনানিতে শিশির মনির বলেন, সাক্ষী ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার পর কোর্টে আসার পর দেখলাম সে ঘটনার তারিখ-সময় বলতে পারছে না। পরে অনেক সাক্ষীকে কোর্টে আনা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ওই সময় ১৭ জনের তালিকা দিয়ে বলা হয়েছিল এরা আদালতে আসতে পারবে না। ট্রাইব্যুনাল ওই আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। যার কারণে আসামি পক্ষ অনেক সাক্ষীকে জেরা করতে পারেনি। অথচ সাক্ষীদের জেরা করা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এটাই সাক্ষ্য আইনের বিধান। অথচ জেরা না করতে অ্যাক্ট ও রুলস পরিবর্তন করা হয়েছিল।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ওই সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কোনো আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আসার সুযোগ ছিল না। বিচারটা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তখন আমরা স্কাইপ কথপোকথন, মেইল যোগাযোগের বিষয়গুলো বার বার বলেছি। সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিকে ট্রাইব্যুলের গেইট থেকে অপহরণ করে ভারতে নিয়ে আটক করে রাখা হয়েছিল। আমরা সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চেয়ে আবেদন করলে তা খারিজ করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিতে না চাইলে তাকে আদালত থেকেই কারাগারে পাঠানো হয়।
জামায়াত নেতাদের প্রসঙ্গ টেনে শিশির মনির বলেন, ১৯৭১ সালের অপরাধের বিচারের জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আইন করা হয়েছিল। সারা দেশে ২৮টি ট্রাইব্যুনাল করে বিচার শুরু হয়েছিল। অথচ ট্রাইব্যুনালে যেসব জামায়াত নেতাদের বিচার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোনো থানায় জিডি পর্যন্ত ছিল না। ১৯৭৩ সালের ওই আইন সংশোধন করে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার সিভিলিয়ানদের বিচারের বিধান করে। বিষয়টি নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন প্রয়াত বিচারপতি টিএইচ খান। সেখানে দেশি–বিদেশি আইনজ্ঞরাও অংশ নিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, এই আইন ও ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানের ছিল না।
এটিএম আজহারের বিষয়ে শিশির মনির বলেন, একজন সাক্ষী ৬ কিলোমিটার দূর থেকে দেখেছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে এটিএম আজহার ট্রেন থেকে নেমে গ্রামে আগুন দিয়েছে। ঘটনার স্থান বর্ণনা করা হয়েছে এক জায়গায়, সাক্ষী বলছে অন্য জায়গায়। একজন সাক্ষী বলছে, তাঁর ছেলে–মেয়ে কয়টি তা সে জানে না। তার সাক্ষ্যও নেওয়া হয়েছে। একজন সাক্ষী বলেছে, তার বাবাকে কে মেরেছে তা তিনি দেখেননি, বাবাও তাকে বলেননি। অন্য একজন বলেছেন এটিএম আজহার মেরেছেন। একজন সাক্ষী পাচক। তিনি কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষকে চিনেন না, অন্য ছাত্র সংগঠনের নেতাদের চিনেন না। অথচ তিনি আজহারুল ইসলামকে চিনেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
শুনানিতে শিশির মনির আরও বলেন, একজন সাক্ষী বলেছে, এটিএম আজহার ঝাড়ুয়ার বিলের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত নন। এসব সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এটিম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি বলেছেন, এসব সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্য না। পরে কয়েকটি অভিযোগ থেকে ওই বিচারপতি তাকে খালাসও দেন।
এর আগে শুনানিতে কাদের মোল্লার বিষয়ে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর খারিজ করা হয়। পরে সংক্ষিপ্ত আদেশে ওইদিন রাতেই তরিঘড়ি করে তার ফাঁসি কার্যকর করে সরকার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচন করার জন্য এই ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কি কারণে রিভিউ খারিজ হলো সেটা আমরা জানতে পারিনি। সাধারণত আসামির মুক্তির জন্য সংক্ষিপ্ত আদেশ ফলো করা হয়। তবে কারও ফাঁসির জন্য সংক্ষিপ্ত আদেশ এটা প্রথম ঘটনা। উপমহাদেশে এমন নজীর আর নেই।
এর আগে, ৬ মে সকাল ১০টায় এটিএম আজহারের আপিল শুনানি শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ে ২, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির দণ্ডাদেশ পান এটিএম আজহার। এছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অমানবিক অপরাধের দায়ে ২৫ বছর ও ৬ নম্বর অভিযোগে নির্যাতনের দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে শুনানির পর ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। আপিল বিভাগের রায়ে ২, ৩, ৪ ও ৬ নম্বর অভিযোগের দণ্ড বহাল রাখা হয়। আর ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। ওই রায়ের রিভিউ চেয়ে একই বছরের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেছিলেন এই জামায়াত নেতা। ২৩ পৃষ্ঠার পুনর্বিবেচনার ওই আবেদনে মোট ১৪টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।