টাকা নিয়ে সেবা বেচেন ওয়ার্ড বয় নাজমুল

বরিশালের উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সরকারি চিকিৎসাসেবা নিতে উপজেলার মানুষ এখানের স্বাস্থ্যসেবার ওপর নির্ভর করে। সেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘিরেই একের পর এক উঠছে নানা অভিযোগ। বলা হচ্ছে—সরকারি সেবা প্রদানেও নানা অজুহাতে নেওয়া হচ্ছে টাকা।
এমন অভিযোগের প্রমাণস্বরূপ একটি ভিডিও এনটিভি অনলাইনের উজিরপুর প্রতিনিধির কাছে পৌঁছে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ড বয় নাজমুল হুদা মাস্ক পরে জরুরি সেবাকক্ষে ১০০ টাকার কয়েকটি নোট নিয়ে তার মানিব্যাগে রাখছেন। অভিযোগকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সপ্তাহখানেক আগে তার বাবার মাথা ফেটে গেলে তিনি তার বাবাকে নিয়ে সেখানে যান। সে সময় মাথার ওপরে তিনটি ও পেছনে একটি সেলাই দিতে ৩০০ টাকা দিতে বাধ্য হন তিনি। সেই চিত্রই তিনি গোপনে ধারণ করেছেন। অপর এক প্রশ্নে তথ্যদাতা বলেন, এর আগে একবার তার চাচির হাত ভেঙে গেলে সে সময়ে ওই হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় নাজমুল ব্যান্ডেজের জন্য ৬০০ টাকা দাবি করেন। তিনি সেই বার ৪০০ টাকা দিয়ে পার পান। তাই এবার আগে থেকেই তিনি ক্যামেরায় ভিডিও মুড ওপেন রেখেছিলেন।
এদিকে, গতকাল সোমবার দুপুরে অভিযোগের প্রেক্ষিতে এই প্রতিবেদক ছদ্মবেশে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। একপর্যায়ে সেখানে ওয়ার্ড বয় নাজমুলকে পান। তার কাছে অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চান। তিনি উত্তর না দিয়ে প্রমাণ দেখতে চান।
একপর্যায়ে প্রতিনিধিকে চিনে ফেললে তাকে চাঁদাবাজি ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন। পরে প্রতিনিধি সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শওকত আলীকে এ সব বিষয়ে জানাতে দুপুর ২ টা ৪৩ মিনিটে ছবি দিয়ে হোয়াটঅ্যাপে দুটি ফুটেজ পাঠালে ডা. শওকত অভিযোগ প্রসঙ্গে উত্তর না দিয়ে তাকে ‘চাঁদাবাজ’ ও ‘দাংগাবাজদের সাথে কথা না বলাই ভালো’ বলে মন্তব্য করেন। অথচ তার সাথে পরামর্শ করে রোগীর কাছ থেকে টানা আদায় করা ওয়ার্ড বয় নাজমুল উজিরপুর মডেল থানায় একটি অভিযোগ করেন। সেই কথার সত্য মেলে অভিযোগপত্রে।
‘উর্ধ্বতন স্যারদের আলোচনা করিয়া থানায় আসিয়া অত্র অভিযোগ দায়ের করিতে বিলম্ব হইল’ উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, দুপুর অনুমান দেড়টায় বিবাদী বোরকা পরে অজ্ঞাতনামা ২/৩ জন বিবাদীদের নিয়ে উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভিতর প্রবেশ করিয়া এনটিভির সাংবাদিক পরিচয় দেয় এবং আমাদের কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।
আজ মঙ্গলবার ওয়ার্ড বয় নাজমুলের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সরকারি কাজে কোনো টাকা নেওয়া হয় না। এ সময় এনটিভি অনলাইনের কাছে তার টাকা নেওয়ার ভিডিও পৌঁছেছে জানালে তিনি জানতে চান, ভিডিও না কি ছবি। ভিডিও মজুদ আছে জানালে তিনি বলেন, কোনো রোগী যদি খুশি হয়ে দেয়, তাহলে তো আমার কিছু করার নেই। এরপর তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, রোগীরা খুশি হয়ে দিলে সেটি নেওয়া বৈধ কি না? এ সময় তিনি কল কেটে দেন। পরে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ব্যস্ত পাওয়া যায়।
পরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শওকত আলীর সাথে কথা বলা হলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এই প্রতিনিধি ‘নাজমুলকে নানাভাবে ইরিটেড (বিরক্ত) করেন।’ কীভাবে বিরক্ত করেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রায় প্রায় আসেন। ছবি তোলেন। বোরখা পরে আসেন।’
নাজমুলের টাকা নেওয়া বৈধ কি না জানতে চাইলে এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রশ্ন করেন, আউট সোর্সিংয়ে চাকরি করে ২৯ মাস বেতন না পেলে কেউ যদি কিছু দেয়, আপনি বলেন, সেটি কী হতে পারে? তার এই বক্তব্যটি প্রসঙ্গে আবারও জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আমার বক্তব্য নয়।
কথা প্রসঙ্গে ডা. শওকত স্বীকার করেন, তার কাছেও নাজমুলের টাকা নেওয়ার ভিডিওটি পৌঁছেছে। এ বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে তিনি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবেন। পরক্ষণেই তিনি জানান, তিনি ভিডিও ফুটেজটি পাওয়ার পর নাজমুলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। নাজমুল তাকে বলেছেন, একজন রোগীর সাথে অ্যাটেনডেন্ট ছিল না। তিনি মেডিসিন আনার জন্য অনুরোধ করলে তিনি টাকাটি নেন।
তার এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে টাকা নেওয়ার ভিডিওটি ধারণকারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে জানান, তার বাবার চিকিৎসার জন্য তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি তার বাবার সাথেই ছিলেন।
পুরো ঘটনার সারসংক্ষেপ মুঠোফোনে তুলে ধরে বরিশাল সিভিল সার্জন ডা. এস.এম. মনজুর-এ-এলাহীর কাছে জানতে চাইলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, বেতন পান কি পান না, তা সরকরি সিদ্ধান্তের বিষয়। এর সাথে রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কোনো সম্পর্ক বা অধিকার থাকতে পারে না। এটি শতভাগ অন্যায়। তিনি আরও বলেন, আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন, আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইনচার্জ (টিএস) ডা. শওকতের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন বলেন, তিনি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। রোগীদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া আইনগত অবৈধ, অপরাধ এবং অন্যায়। প্রতিনিধির বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি নিয়ে আমি খুবই বিব্রত। আমি কথা দিতে পারি—এ বিষয়ে আমি অবশ্যই বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেব।
এর আগে এই হাসপাতাল নিয়ে ১২ মে ‘বরিশাল উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনিয়মে অতিষ্ঠ রোগীরা’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন করতে গেলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা হাসপাতালটির নানা অনিয়ম তুলে ধরেন। সেদিন সন্তানকে ডাক্তার দেখাতে আসা এক নারী জানান, এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষার পরও মেলেনি চিকিৎসক। আরও কয়েকজন চিকিৎসকের দেখা পাচ্ছেন না বলে জানান। অপর একজন জানান, ৭/৮ মাস ধরে তিনি সেখান থেকে ওষুধ পান না।
এ দিন চিকিৎসকের দরজার বাইরে রোগীদের লম্বা লাইন দেখা দেখা যায়। অথচ দরজা খুলতেই ক্যামেরা দেখে বাইরে বেরিয়ে আসেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। তারা ক্যামেরার সামনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।