কোটালীপাড়ায় বৃষ্টিতে ভিজছে ‘জ্ঞানের আলো পাঠাগার’ এর হাজারো বই

“চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
-যে কবি প্রাণপণে এই পৃথিবীর জঞ্জাল সরাতে চেয়েছিলেন সেই কবি পৈতৃক ভূমিতেই উপেক্ষিত। গাছপালা, জঞ্জালের মধ্যে পড়ে আছে তার কয়েকটি ছবি। ছবিগুলো প্রতিদিন বৃষ্টিতে ভিজছে। শুধু ছবিই নয়, তার কবিতার বইগুলোও ভিজছে বৃষ্টির পানিতে।
শুধু কি কবি সুকান্তের কবিতার বই? না, দেশবরেণ্য শত শত কবি-সাহিত্যিকদের লেখা কয়েক হাজার বই প্রতিনিয়ত ভিজছে বৃ্ষ্টির পানিতে। বইগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাজারো মানুষ। কিন্তু কারোরই চোখে পড়ছে না এই দৃশ্য।
গত রোববার (১৫ জুন) গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড কোটালীপাড়া উপজেলার ঘাঘর বাজারের আশপাশ এবং তারাশী বাসস্ট্যান্ডের বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে। এই সাথে তারাশী বাসস্ট্যান্ডে নির্মিত ‘জ্ঞানের আলো পাঠাগারটিও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগ মুহূর্তে পাঠাগারটির কয়েক হাজার বই ও আসবাবপত্র ঘরের বাইরে খোলা আকাশের নিচে রেখে দেওয়া হয়। এ সংবাদ লেখার আগ পর্যন্ত বই এবং আসবাবপত্রগুলো খোলা আকাশের নিচে রয়েছে এবং বৃষ্টির পানিতে ভিজে নষ্ট হচ্ছে।
জ্ঞানের আলো পাঠাগারের সভাপতি সুশান্ত মন্ডল বলেন, ২০১৪ সালের মার্চ মাসে আমরা এলাকার উদ্যমী যুবকরা মিলে এই পাঠাগারটি নির্মাণ করি। এরপর বই পড়ার পাশাপাশি আমরা আর্তমানবতার সেবায় কাজ শুরু করি। ফেসবুকের মাধ্যমে টাকা তুলে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে গরীব অসহায় মানুষদের চিকিৎসাসেবা দেই। করোনাকালীন অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ওষুধ নিয়ে রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সেবা দিয়েছি। গত বছর বন্যার সময় আমরা কুমিল্লায় ত্রাণ দিয়েছি। এছাড়া আমরা আরও অনেক মানবিক কাজ করেছি, যেগুলো এলাকায় মানুষ জানেন।
সুশান্ত মন্ডল আরো বলেন, এই পাঠাগারের জায়গাটি জেলা পরিষদ আমাদেরকে বন্দোবস্ত দিয়েছিল এবং তাদের অর্থায়নে পাঠাগারের ঘরটি নির্মাণ করা হয়। তারপরও কেন এই পাঠাগারটি জেলা পরিষদ কোন প্রকার নোটিশ ছাড়া ভেঙে গুড়িয়ে দিলো, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
পাঠাগারটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদ পারভেজ বলেন, আমাদের এটি একটি নিবন্ধিত পাঠাগার। পাঠাগারের সকল কাজই আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে করে থাকি। তার পরেও আমাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে কোন অভিযোগ থাকলে সে বিষয়ে তদন্ত করে দেখা উচিৎ ছিল। কিন্তু তা না করে এভাবে একটি জ্ঞানের প্রদীপকে নিভিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি বলে আমি মনে করি।
ঢাকায় বসবাসরত কোটালীপাড়ার যুব পেশাজীবীদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘কোটালীপাড়া কল্যাণ সংঘ’র সভাপতি সোহেল শেখ বলেন, জ্ঞানের আলো পাঠাগার কোটালীপাড়ার শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিকতার এক অনন্য বাতিঘর। এই পাঠাগার শুধু বই পড়ার জন্য নয়, এটি শত শত তরুণের স্বপ্ন গড়ার একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান। এখান থেকেই কোটালীপাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে মানবিক সহায়তা, রক্তদান আন্দোলন, পথশিশুদের সাপোর্ট ও করোনাকালীন অক্সিজেন সেবা। অথচ আজ আমরা গভীর বেদনা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, এই মহৎ প্রতিষ্ঠানটিকে উচ্ছেদের নোংরা ও নির্মম পদক্ষেপের শিকার হতে হয়েছে।
সোহেল শেখ আরো বলেন, আমি মনে করি, এটি কেবল একটি ভবন উচ্ছেদের ঘটনা নয়, এটি জ্ঞান ও মানবিকতার ওপর সরাসরি আঘাত। এই পাঠাগারটি শুধু বই পড়ার স্থান নয়, এটি একটি সমাজের বিবেক। যারা পাঠাগারকে গুঁড়িয়ে দেয়, তারা আসলে অন্ধকারের সঙ্গী।
কবি ও লেখক খালিদা তালুকদার বলেন, অসভ্য ও বর্বরতা কোন লেভেলে পৌঁছালে একটা পাঠাগার গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। জ্ঞানের আলো পাঠাগার শুধু একটি গ্রন্থাগারই নয়, অসংখ্য সামাজিক ও মানবিক কাজের সাথে যুক্ত থাকার অনেক উদাহরণ তাদের রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে গুঁড়িয়ে দেবার সাহস কে দিলো? কেন গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো? সেটা ভেবে অবাক হচ্ছি! শুধু ক্ষোভ নয়, আফসোস হচ্ছে প্রশাসনের অশিক্ষা আর মূর্খতার দৌরাত্ম্য দেখে!

কবি ও লেখক মিন্টু রায় বলেন, গত মঙ্গল ও বুধবার কোটালীপাড়ায় অনেক বৃষ্টি হয়েছে।এই বৃষ্টিতে ভিজেছে জ্ঞানের আলো পাঠাগারের অনেক বই। এই বইগুলোর মধ্যে আমার লেখা দুটি কবিতা ও একটি গল্পের বইও রয়েছে। একজন লেখকের বই হচ্ছে তার সন্তানের মতো। সেই সন্তানের মতো বইগুলো ভিজে ভিজে নষ্ট হচ্ছে! এটা সত্যিই দুঃখজনক।
মিন্টু রায় আরো বলেন, মাঝে মাঝেই আমরা কবি, লেখকরা মিলে জ্ঞানের আলো পাঠাগারে বসে সাহিত্য আড্ডা দিতাম। এই প্রতিষ্ঠানটিকে আমাদের খুব নিজেদের মনে হতো। সেই প্রতিষ্ঠানটিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় মনে হচ্ছে আমার পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙে গেছে।
বাংলাদেশ গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের সভাপতি আবদুস সাত্তার খান বলেন, যে কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান করা অনেক কঠিন ব্যাপার। সেই প্রতিষ্ঠানটা যখন ধ্বংস করা হয় তখন সে ইতিহাসটা হয়ে যায় অনেক বেদনার, লজ্জার, গ্লানির। শুধু প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে জ্ঞানের আলো পাঠাগারকে ধ্বংস করা হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। দেশব্যাপী কঠোর আন্দোলন শুরুর আগেই আমারা দাবি জানাই জ্ঞানের আলো পাঠাগার পূর্বের ন্যায় গড়ে তোলা হোক।

গোপালগঞ্জে জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত দেবনাথ বলেন, গত রোববার (১৫ জুন) সড়ক ও জনপদ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং জেলা পরিষদ যৌথভাবে কোটালীপাড়ায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছে। এই অভিযানে যে প্রতিষ্ঠানটিকে অবৈধ মনে করা হয়েছে সেটিকেই উচ্ছেদ করা হয়েছে।