আজোয়া, মরিয়মসহ ৫ জাতের খেজুরের বাগান করে চমক জাকিরের

২০১৯ সালে ইউটিউব দেখে স্বপ্ন বুনেন একদিন বাগেরহাটের লবণ পানিতে সৌদির প্রসিদ্ধ জাতের খেজুর ফলাবেন, হবেন বাগানের মালিক। এই স্বপ্ন থেকে চিংড়ি ঘেরের মাটি কেটে বাগান বানানো শুরু করেন তিনি। আর সেই সখের বাগানে বর্তমানে ৪০০ খেজুর গাছ। এর মধ্যে ফল ধরেছে অর্ধশতাধিক গাছে। এতে বাগেরহাট জজ কোর্টের আইনজীবী জাকির হোসেন হয়ে গেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা। স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে নিজেই এখন সৌদির খোরমা খেজুর বাগানের মালিক। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তিনি এই অবস্থায় এসেছেন বলে জানিয়েছেন। উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের লোনা মাটিতে এবার নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছেন অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন। উপকূলীয় রামপাল উপজেলার সন্ন্যাসীর হাজীপাড়া এলাকায় গড়ে তুলেছেন বিরাট খেজুর বাগান।
জাকির হোসেন জানান, তার ৩০ বিঘা জমির চিংড়ি মৎস্য ঘেরের বেড়িবাঁধে খেজুর গাছ লাগিয়েছেন। এখন তার খেজুর বাগানে গাছের সংখ্যা প্রায় ৪০০। প্রথমে এলাকাবাসী উপহাস করলেও গত দুই বছর ধরে খেজুরের ফলন দেখে অবাক। তার বাগানের গাছে ঝুলছে আজোয়া, মরিয়ম, আম্বার, বারিহীসহ অন্তত পাঁচ জাতের খেজুর।
বাগান পরিদর্শনে আসা পিসি কলেজের ছাত্র বাদশা বলেন, ‘আমার বাড়ি যাত্রাপুর। আমি রামপাল এসেছি জাকির হোসেনের সৌদি খেজুরের বাগানটি দেখার জন্য। মরুভূমির সৌদি আরবের খেজুর আমাদের দেশে চাষ হচ্ছে। এটি সত্যিই অবাক করার মতো। গাছগুলোতে ফলনও বেশ ভালো হয়েছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা সুমন বলেন, ‘জাকির হোসেন আমাদের সবার পরিচিত। তিনি ভালো মনের মানুষ। তার এই খেজুরের সারি সারি গাছ দেখে অবাক হয়েছি। মরুর দেশে জন্ম নেওয়া খেজুর এখন আমাদের এই অঞ্চলে চাষ হচ্ছে, ভাবতেই খুব ভালো লাগছে। গাছগুলোকে এত সুন্দর ও পরিপাটিভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মন ভরে গেছে। এলাকাবাসী ও প্রশাসনের সহায়তা এবং অনুপ্রেরণা পেলে আরও ভালো করতে পারবেন আশা করি।’
বাগান তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা রেজাউল তরফদার বলেন, খেজুর গাছের পরিচর্যা নিয়ে অনেকেই হতাশ। তবে এই খেজুর গাছের পরিচর্যা তেমন কিছু নয়। জৈব সার প্রয়োগ করি এবং মাসে একবার গাছগুলোতে স্প্রে করে দেই। তবে ‘গন্ডার পোকা’ গাছের মূল খেয়ে ফেললে গাছ যায়। এই পোকার ওষুধ পাওয়া গেলে গাছের ফলন আরও ভালো হবে। তাই গাছগুলো যেন রোগমুক্ত থাকে, সেজন্য সময়মতো ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। খেজুরের ফুল ফোটা থেকে শুরু করে ফল পাকার প্রতিটি ধাপেই আলাদা মনোযোগ দিতে হয়। যেমন ধরুন, গাছের গোড়ায় আগাছা পরিষ্কার করা। পাখি, ইঁদুর ও পোকামাকড় খেজুর খেয়ে ফেলে। এ ছাড়া বৃষ্টির সময় প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে দিতে হয়, কারণ বৃষ্টির পানি লেগে খেজুর নষ্ট হয়ে যায়। গাছে কলম বাঁধতে হয়। এই খেজুর গাছের সব চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হচ্ছে কটা পোকা। এটা ধরলে গাছ মারা যায়। আর এই খেজুর পাকা শুরু করলে একটা গন্ধ ভেসে বেড়ায় আর সেই গন্ধে পাখি আসে খেজুর নষ্ট করে ফেলে।
সফল উদ্যোক্তা অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন বলেন, ২০১৪ সালে ৩০ বিঘা জমিতে ৯টি পুকুর খনন করে চিংড়ি ও সাদা মাছ চাষ শুরু করি। পুকুরের পাড়জুড়ে বিভিন্ন ফলজ গাছও রোপণ করি, কিন্তু লোনা পানির জন্য এসব ফসলে লাভ হচ্ছিল না। অন্যদিকে, অতিরিক্ত লোনা পানির কারণে ঘেরে গলদা চিংড়ি বা কার্প জাতীয় মাছ ভালো হয় না। তারপর কয়েক বছরে বাগদা চিংড়িতেও লোকসানে পড়ি। পরে হতাশা কাটিয়ে উঠতে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘রামপাল সৌদি খেজুর বাগান’ নাম দিয়ে এই খেজুর চাষ শুরু করি। প্রথম দিকে লোকজন আমাকে বলেছে, নোনা পানি এবং মাটিও নোনা। এত টাকার চারা রোপণ করলে কি বাঁচবে? কিন্তু আমি তাদের কথা না শুনে শুরু করি আমার পথ চলা। ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে ৬০টি সৌদি খেজুরের চারা এনে রোপণ করি। বর্তমানে আমার বাগানে আজোয়া, মরিয়ম, সুকারি, আম্বার ও বারহি—এই পাঁচ জাতের ৪০০টি ছোট-বড় মিলিয়ে খেজুর গাছ রয়েছে। বর্তমানে ৮০টি গাছে ফলন হলেও আগামী এক বছরের মধ্যে বাগানের অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ গাছে খেজুর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী বছর থেকে বাণিজ্যিক উপায়ে আরও খেজুর ও চারা বিক্রি করতে পারব।
জাকির হোসেন আরও বলেন, যারা নতুন এই চাষের পরিকল্পনা করছেন, তাদের অবশ্যই একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে কলম ও বীজ। দুভাবেই সৌদি খেজুরের চারা তৈরি হয়। এই বীজের চারার বেশিরভাগ পুরুষ হয়ে যায়। এতে ফল আসে না। তাই নতুন যারা শুরু করবে, তাদের কলমের (অপ শুট) চারা কেনার জন্য পরামর্শ দেন তিনি। বাগানে সার্বক্ষণিক তিনজন কর্মচারী রয়েছে। ভবিষ্যতে এই আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোতাহার হোসেন বলেন, খেজুর মরুভূমির ফসল। লোনা পানির জমিতে এই ফসল চাষের খবর শুনে প্রথমে একটু অবাকই হয়েছিলাম। পরে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি, অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন নামের এক ব্যক্তি খেজুর চাষে সফলতা পেয়েছেন। এখন যদি খেজুরের স্বাদ, পুষ্টিগুণ ও উৎপাদনের পরিমাণ ঠিক থাকে, তাহলে লোনা পানির এলাকার জন্য এটি একটি নতুন দৃষ্টান্ত হবে।
খেজুর চাষের এই উদ্যোগকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।