ইটভাটায় আধুনিক চিমনি কমাবে ৫৮ শতাংশ বায়ু দুষণ

মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে স্থাপিত ব্রিক ফিল্ডের চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়। এতে মারাত্মকভাবে দূষিত হয় বাতাস। জীবনের জন্য হুমকি ও বিপর্যয়কর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বায়ুমণ্ডলে। ব্যাহত হয় মানুষের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন, স্বাস্থ্যের জন্য তৈরি হয় নানা সংকট।
ইটভাটার কালো ধোঁয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই ধোঁয়ায় থাকে মিথেন, দুষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রাস অক্সাইড নামক তিনটি ক্ষতিকর পদার্থ। এটি শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ, অ্যালার্জি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া, শিশুদের জন্য এটি আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।
পরিবেশ, সুস্থ এবং সুরক্ষিত জীবনের জন্য ইটভাটায় সৃষ্ট পরিবেশের বিপর্যয় এড়াতে পরীক্ষামূলকভাবে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার কুষ্টিয়া নামাপাড়ায় একটি ইট ভাটায় স্থাপিত হয়েছে উদ্ভাবক আলী হোসেনের কার্বো-পিউরিফিকেশন টেকনোলজি (সিপিটি) ‘ইটভাটায় কার্বন পিউরিফিকেশন প্ল্যান্ট’। এই প্ল্যান্ট স্থাপনের ফলে উৎপাদন খরচও কিছুটা কমবে। এটি স্থাপনে ব্যয় হবে মাত্র ৩০ লাখ টাকা।
২০২০ সালে কার্বন পিউরিফিকেশন প্ল্যান্ট নামে পরিবেশবান্ধব এ প্ল্যান্ট তৈরির পর উদ্ভাবক আলী হোসেন প্রকল্পটির পাইলটিং শুরু করেন ২০২২ সালে। পরে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে তার প্ল্যান্ট স্থাপন শুরু করেন ইটভাটার মালিকরা। তাদের একজন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার এবিসি ব্রিক্সের মালিক রুহুল আমিন। তিনি দুই একরের একটি ইটভাটায় এই প্ল্যান্ট স্থাপন করেছেন।
এবিসি ব্রিক্সফিল্ডে গিয়ে দেখা যায়, দুটি চিমনি। একটি মান্ধাতার আমলের অন্যটি আধুনিক চিমনি। তবে মান্ধাতার আমলের চিমনিটি বন্ধ। পাশেই আলী হোসেনের আধুনিক চিমনি দিয়ে বের হচ্ছে পরিবেশবান্ধব সাদা শীতল বাষ্প। এটি মূলত আট চেম্বারবিশিষ্ট আন্ডার গ্রাউন্ড একটি পানি প্রবাহ বা ওয়াটার স্প্রে চ্যানেল। যে চ্যানেল দিয়ে কার্বন মিশ্রিত কালো দূষিত পানি ওয়াটার স্প্রে চ্যানেলের মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে থাকে। ফলে কালো ধোঁয়ার পরিবর্তে আলী হোসেনের আধুনিক চিমনি দিয়ে সাদা ও শীতল বাষ্প আকারে বের হয়ে মিশে যাচ্ছে বায়ুমণ্ডলে। ফলে সেই ব্রিক ফিল্ডের কালো ধোঁয়া দ্বারা আর পরিবেশ দূষণ হচ্ছে না। অন্যদিকে কার্বন মিশ্রিত পানি ফিল্টারের মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে একটি চৌবাচ্চায় গিয়ে পড়ে। সেখানে জমা হচ্ছে কার্বনের গাদ। সে গাদ আহরণ করে তা পুনরায় ভাটায় ব্যবহার করছে ইটভাটার মালিক। তাতে মালিকের উৎপাদন খরচও কমছে বেশ।
এই চিমনির উদ্ভাবক আলী হোসেন জানান, ২০২১ সালে তার উদ্ভাবিত সিপিটি প্ল্যান্ট শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ‘প্যাটেন্ট’ মালিকানা স্বত্ব পায়। এর পরপর মন্ত্রণালয়ের আদেশে গঠিত পরিবেশ অধিদপ্তর পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটি তার প্ল্যান্টের কারিগরি কার্যক্ষমতা যাচাই-বাছাই করে ইতিবাচক প্রতিবেদন দেয়। ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশবান্ধব বিধায় বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতিকে আলী হোসেনের প্ল্যান্ট ব্যহারের জন্য চিঠি দেয়।
আলী হোসেন বলেন, বাণিজ্যিকভাবে প্ল্যান্ট বাজারজাত করে মুনাফা তোলাই আমার উদ্দেশ্য নয়। পরিবেশবান্ধব উন্নত এ প্রযুক্তি কলকারখানায় ও ইটভাটায় স্থাপন করলে নির্গত কালো ধোঁয়া ওয়াটার স্প্রে প্ল্যান্টের মাধ্যমে ফিল্টারিং হয়ে জিরো কার্বনে সাদা শীতল বাষ্প আকারে পরিবেশবান্ধব নতুন চিমনি দিয়ে বের হবে। তাতে কারখানার নির্গত বায়ু দূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। ফলে কারখানাগুলো পরিবেশবান্ধব হবে এবং নির্গত কালো ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে স্থানীয় জনসাধারণ মুক্তি পাবে। কৃষির কোনো ক্ষতি হবে না। পশু-পাখির বাসস্থান ঠিক থাকবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কবল থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে এবং সবুজ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। এই প্ল্যান্ট স্থাপনে খরচ হবে মাত্র ৩০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মুরাদ আহমেদ ফারুক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সয়েল ইকোলজি অ্যান্ড ফার্টিলিটি ল্যাবে’ পরীক্ষা করে দেখা গেছে ইটভাটার কালো প্রথম ধাপের চেম্বারের নমুনায় পাওয়া ধোঁয়ায় দূষিত ক্ষুদ্রবস্তুকণার পরিমাণ পিপিএম ২.৫ সমান ৩১৪ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে। আর প্রথম ধাপের ছাকনির পর সেই ধোঁয়ায় পাওয়া গেছে ২৩৭ পিপিএম ক্ষুদ্রবস্তুকণা। আর আট চেম্বার বা পানি ফিল্টার দিয়ে বিশুদ্ধ হয়ে আধুনিক চিমনি দিয়ে বের হওয়া সাদা ধোঁয়া থেকে বের হচ্ছে মাত্র ৩২ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে। যা পুরনো চিমনিতে প্রথম ধাপে ৭৪৭ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার মিথেন নির্গত হতো। সেখানে আট চেম্বারের ফিল্টারিং করার পর ৯০ শতাংশ মিথেন নির্গমন হ্রাস পেয়েছে। একই ভাবে পুরনো চিমনি দিয়ে যেখানে ১১ হাজার ৮২২ পিপিএম কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হতো সেখানে আধুনিক চিমনি দিয়ে বের হচ্ছে মাত্র তিন হাজার ৭৭৬ পিপিএম অর্থাৎ ৩২ শতাংশ কম।
অন্যদিকে নাইট্রাস অক্সাইড প্রথমে বের হত ৭ পিপিএম আর আধুনিক চিমনি দিয়ে বের হচ্ছে মাত্র ৩ পিপিএম অর্থাৎ ৫০ শতাংশ কম। উপরোক্ত তিনটি উপাদান বায়ু মণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। তাই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আলী হোসেনের প্ল্যান্ট ইটভাটায় ব্যবহারে মত দেন এই বিজ্ঞানী।
এই বিজ্ঞানীর মত, দেশে প্রায় সাড়ে আট হাজার ইটভাটা রয়েছে। এই ইটভাটাগুলো বায়ু দুষণের জন্য প্রায় ৫৮ শতাংশ দায়ী। উদ্ভাবিত প্ল্যান্ট ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলের দূষণ কমবে ৫৮ শতাংশ।