অযত্ন অবহেলায় ঐতিহাসিক তিন নেতার মাজার

অবহেলায় জীর্ণ দশায় পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরসংলগ্ন ঐতিহাসিক তিন নেতার মাজার। মাদকসেবী ও ভবঘুরেদের দখলে থাকা এই স্থাপনা এখন নিরাপত্তাহীনতা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারাতে বসেছে ঐতিহাসিক মর্যাদা।
স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সাবেক তিন প্রধানমন্ত্রী—হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ.কে. ফজলুল হক ও খাজা নাজিমুদ্দিনকে স্মরণে ১৯৮৫ সালে নির্মিত হয় তিন নেতার মাজার। এক সময় প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত থাকলেও বর্তমানে স্থাপনাটি খোলা ও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বলছেন, তিন নেতার মাজার আগে প্রাচীর দিয়ে রক্ষিত ছিল। কিন্তু সম্প্রতি, বিশেষ করে ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার ঘটনায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বন্ধ করে দেওয়ার পর এই স্থাপনার নিরাপত্তা নাজেহাল হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, নিরাপত্তা বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত কেউকে পাওয়া যায়নি। মাজারের একেবারে সম্মুখ দিকে বড় একটি অংশের সীমানা প্রাচীর নেই। এ ছাড়াও, প্রাচীরের বেশ কয়েকটি জায়গায় লোহার বেড়ি নেই। এসব জায়গা দিয়ে মানুষ অবাধে মাজারে প্রবেশ করছে। এদিকে, ঢাকা গেট সংলগ্ন সীমানা প্রাচীর পুরোটাই উধাও হয়ে গেছে।
মাজারের সামনে ফুটপাতের একজন দোকানদার বলেন, ‘ভবঘুরে ও পথশিশুরা দেওয়ালের এমন অবস্থা করেছে। তারা অর্থের বিনিময়ে দেওয়ালের রড বিক্রি করে দিচ্ছে। তাই, ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এই দেওয়াল।’ নিরাপত্তার স্বার্থে ওই দোকানি নাম প্রকাশে অনিচ্ছা পোষণ করেছেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে স্থানান্তরিত ভবঘুরেদের আবাসস্থল
গত ১৩ মে, দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য। এরপর থেকে প্রশাসনের উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ভবঘুরে ও মাদক ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হয়।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর এইসব ছিন্নমূল মানুষ বর্তমানে তিন নেতার মাজারে আশ্রয় নিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাজারের মূল বেদীতে বেশ কয়েকজন মানুষ শুয়ে অথবা বসে আছেন। এমনকি কবরের আশেপাশের জায়গায় অসংখ্য ব্যক্তি বসে আছেন। কেউ কেউ ঘুমিয়েও আছেন। এ সময় অনেককে মাদক গ্রহণ করতেও দেখা যায়।
কবরের উপরে বসে থাকা কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলে তাদের মধ্যে একজন পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি বলেন, ‘কই যাবো বলেন? আমাদের তো যায়গা নাই। আমরা এখন মাজারেই থাকি।’
এসব ব্যক্তির বেশিরভাগই মাদক ব্যবসায়ী অথবা মাদক সংশ্লিষ্ট বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র মতে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বন্ধ হওয়ার পর থেকে তিন নেতার মাজার মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। জানা যায়, ঢাকা গেট সংলগ্ন দুই পাশের সরু জায়গা, মেট্রোরেলের পিলারের নিচে এমনকি অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাস্তার ওপরেই প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হচ্ছে। মাদক ক্রয়ের পর ক্রেতারা মাজার প্রাঙ্গণেই সেবনে নিয়োজিত হচ্ছে।
তিন নেতার মাজার গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতাধীন হলেও এলাকায় কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা প্রহরী নেই। সরেজমিনে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে শাহবাগ থানার একটি টহল দল এসে কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক ও মাদকগ্রহিতাদের মাজার থেকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু অভিযানের মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অবস্থা পুরোপুরি একই। আবারও পুরোদমে মাদক বিক্রি হচ্ছে ও বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সেবনকারীরা মাদকের ভয়াল থাবায় ঢুকে পড়ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্য হত্যার পর থেকে নিয়মিতই এমন অভিযান পরিচালনা হচ্ছে। কিন্তু মাদকের বেচাকেনা কমানো যাচ্ছে না। এ সময় ১৪-১৫ বছরের এক মাদক কারবারিকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘আগে উদ্যানে বেচতাম, উদ্যান থেকে বের করে দেওয়ার পর এইখানে গাঁজা বেচি।’
কোথায় বসবাস জিজ্ঞেস করলে সে মাজারের মূল বেদী আঙুল দিয়ে লক্ষ্য করে দেখায়। মাদকগুলো কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করলে ওই শিশু ‘নবী’ নামের এক ব্যক্তির নাম বলেন।
‘নবী’র বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৫ জুন বিকালে রাজধানীর শাহবাগে শিশুপার্কের সামনে ছুরিকাঘাতে মোবারক (১৮) নামে এক যুবক খুন হয়েছিল।
এ সময়, নিহতের চাচাতো ভাই রবিউল ইউএনবিকে জানিয়েছিলেন, নবী নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে মাদকের টাকা আদায় নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এই খুন হয়।
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মনসুর জানান, ‘প্রতিদিনই আমাদের অভিযান, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাতেও আমরা তিন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক ও এক কেজির বেশি গাঁজা জব্দ করেছি। এর মধ্যে একজনকে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই মাদকের কারবার থামানো সম্ভব নয়।’
ওসি খালিদ মনসুর বলেন, ‘খুব শিগগিরই আমরা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, র্যাবের সঙ্গে যৌথ অভিযান পরিচালনার কথা ভাবছি।’
ওসি বলেন, ‘আমরা উদ্যানের সীমানা প্রাচীর ঠিক করার ব্যাপারে গণপূর্ত অধিদপ্তরকে অবহিত করেছি। আমরা আমাদের মতন কাজ করে যাচ্ছি। তারাও যেন এগিয়ে আসে— সে ব্যাপারে আমরা বারবার বলছি।’
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সেটি সম্ভব হয়নি।
ঐতিহাসিক তিন নেতার মাজার কেবল একটি কবরস্থান নয়, এটি ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়ের স্মারক। তবে, বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, ভবঘুরে ও মাদকসেবীদের দখল ও নিরাপত্তাহীনতা—সব মিলিয়ে স্থাপনাটির ভবিষ্যৎ এখন শঙ্কার মুখে পড়ছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ও সচেতন নাগরিকেরা।