‘ওসি হয়েও আমার কম দামি ফোন, আপনি দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই হবেই’

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। সবশেষ বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাতে মোহাম্মদপুর থানার কাছে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন এক সাংবাদিক। আহমাদ ওয়াদুদ নামের ওই সাংবাদিক থানা থেকে মাত্র ৩ মিনিট হাঁটার দূরত্বে ছিনতাইয়ের শিকার হন। এসময় চাপাতি দিয়ে আঘাত করে ছিনতাইকারীরা তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ কেড়ে নেয়।
এ ঘটনায় ওয়াদুদ তাৎক্ষণিকভাবে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে ছিনতাইয়ের ঘটনা জানান। ঘটনা শুনে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান নিজের মোবাইল ফোন দেখিয়ে ভুক্তভোগীকে বলেন, ‘আমি ওসি হয়েও এই কম দামি ফোন ব্যবহার করি, আপনি এত দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই তো হবেই!’
ছিনতাইয়ের ঘটনার প্রায় দুই ঘণ্টা পর ভোক্তভোগি ওই সাংবাদিক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে বিষয়টি জানান। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র নিন্দা জানান নেটিজেনরা। ছিনতাইয়ের ঘটনার পর ওসির এমন আচরণে ক্ষুব্ধ অনেকেই।
ছিনতাইয়ের ঘটনার পর পুলিশের সহযোগিতা না পেয়ে ভুক্তভোগী আহমাদ ওয়াদুদ নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন।
তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, আজ (বৃহস্পতিবার) রাত ১১টার দিকে মোহাম্মদপুরে আমার সঙ্গে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারীরা আমার একটি মোবাইল ফোন এবং কিছু টাকা-পয়সাসহ মানিব্যাগ নিয়ে যায়। আমাকে চাপাতি দিয়ে কিছু আঘাত করে। সৌভাগ্যবশত আঘাত গুরুতর নয়। আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী ছিলেন। একটু দূরে থাকায় তিনি নিরাপদ ছিলেন।
ঘটনাস্থল থেকে মোহাম্মদপুর থানার অবস্থান ৩ মিনিট হাঁটার দূরত্বে। আমি এবং আমার স্ত্রী ঘটনার ৫ মিনিটের মধ্যে থানায় যাই। সোজা ডিউটি অফিসারের রুমে গিয়ে বলি, ৫ মিনিট আগে তিন রাস্তার মোড়ে আমার সঙ্গে একটি ছিনতাই হয়েছে। তারা আমাকে বললেন, একটু অপেক্ষা করেন, দেখছি।
ডিউটি অফিসারের নাম এসআই জসিম। তার পাশে সাদা পোশাকে একজন পুলিশ সদস্য কাগজে অন্য একজনের অভিযোগ লিখছেন। সাদা পোশাকের ওই পুলিশ সদস্য আমার দিকে আঙুল তাক করে উগ্রভাবে বলেন, আপনার শার্টের বোতাম লাগান। আমি তখনই খেয়াল করলাম, ছিনতাইকারীদের আঘাতের সময় আমার একটি বোতাম খুলে গিয়েছিল। আমি ওই অফিসারের কথায় আহত হলেও কোনো ঝামেলায় না গিয়ে ‘সরি’ বলে বোতামটি লাগিয়ে নিলাম। এরপর তিনি আমাকে আমার সবগুলো বোতাম লাগাতে বললেন। আমার তখন শুধু টাই-বাটন, অর্থাৎ একদম গলার সঙ্গে থাকা বোতামটি খোলা ছিল, যেটা সাধারণত আমরা কখনো লাগাই না। আমি বললাম, প্লিজ আমার অভিযোগটি নিন।
তারা বললেন, অভিযোগ লেখার লোক নেই। আমি তাদের বললাম, আমি নিজেই লিখে দিচ্ছি। আমাকে একটি কাগজ দিন। তারা কয়েক মিনিট পর আমাকে একটি সাদা কাগজ দিলেন। আমি একটি কলম দিতে অনুরোধ করলাম। অফিসার বললেন, আমাদের এক্সট্রা কলম নেই। অথচ সেখানে অনেকগুলো কলম পড়ে ছিল।
ভুক্তভোগী আরও লিখেছেন, যাহোক আমার স্ত্রী নিজের ব্যাগ খুঁজে আমাকে একটি কলম দিলেন। আমি সেটা দিয়ে আমার অভিযোগ লিখলাম। ডিউটি অফিসার আমার অভিযোগের কোনো কপি দিলেন না। শুধু আমাকে একটি ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, এটা এএসআই আনারুলের নম্বর। উনি এখন নবোদয় হাউজিংয়ে ব্যস্ত আছেন। আপনি ফোনে উনার সঙ্গে কথা বলেন।
আমি তখন তাকে বিনীতভাবে বললাম, আমার মনে হয় এখন ঘটনাস্থলে গেলে ওদের পাওয়া যাবে। দয়া করে এমন কাউকে বলুন, যিনি আমাদের সঙ্গে এখন সেখানে যেতে পারবেন।
এসআই জসিম আমার কথায় প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বললেন, এটা সম্ভব নয়। ওই এলাকায় ইনি ছাড়া আর কেউ যেতে পারবে না। এটা তার এলাকা। আপনি এখান থেকে এখন চলে যান। ওখানে গিয়ে ছিনতাইকারীদের পাবেন না।
আমি বললাম, আমার ধারণা ওরা ওখানে এখনো আছে। তবে এসআই জসিম বললেন, আপনার কমন সেন্স নাই? ছিনতাইকারী আপনার-আমার জন্য বসে থাকবে নাকি? আমি তবু তাকে অনুরোধ করলাম, কাছেই যেহেতু, যেন একবার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়।
আমি সেখান থেকে বের হয়ে ওসি সাহেবের রুমে যাই। ওসি ইফতেখার হাসান সাদা পোশোকে ছিলেন। আমি তাকে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি বললাম। তিনি বললেন, ‘আমি ওসি হয়েও এই কম দামি ফোন ব্যবহার করি, আপনি এত দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই তো হবেই!’
আমি তার কথায় কোনো উত্তর দিলাম না। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, যেন এখনই আমার ছিনতাইয়ের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন। তিনি পুর্বোক্ত এএসআই আনারুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে তার জন্য বাসস্ট্যান্ড মোড়ে অপেক্ষা করতে বলেন।
আমি বাসস্ট্যান্ডসহ মোট তিনটি পয়েন্ট ঘুরে এএসআই আনারুলের সঙ্গে দেখা করি। তার সঙ্গে আরও সাত-আটজন পুলিশ সদস্য ছিল। আনারুল সাহেব আমার কথা শুনে বলেন, চলেন আমরা ঘটনাস্থলে যাই। আমি তার সঙ্গে গাড়িতে করে ঘটনাস্থলে যাই। এর মধ্যে প্রায় ৪০ মিনিট পার হয়ে গেছে। তবে ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর আমি ওই ছিনতাইকারীদের সেখানেই বসে থাকতে দেখি। আমি দূর থেকে তাদের দেখিয়ে দিলেও এএসআই আনারুল সেখানে না গিয়ে একটু দূরে অন্য একটি জায়গায় গিয়ে কিছু লোকের সঙ্গে কথোপকথন করেন।
মিনিট দুয়েক পর তিনি ফিরে এলে আমি এএসআই আনারুলকে আবার ওই সন্ত্রাসীদের দেখিয়ে দিই। তবে আনারুল সেখানে না গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এসময় সন্ত্রাসীরাও পুলিশসহ আমাকে দেখে আস্তে আস্তে ঘটনাস্থল থেকে সরে যেতে থাকে। আমি অবাক হয়ে এএসআই আনারুলের দিকে তাকিয়ে থাকি!

আহমাদ ওয়াদুদ ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ওরা চলে যাওয়ার পর এএসআই আনারুল আমাকে বলেন, এখন তো ওদের পাওয়া যাবে না। আমরা গভীর রাতে এসে এখানে অভিযান চালাবো। আপনারা এখন বাসায় চলে যান।
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি ইফতেখারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আসলে উনি (ওয়াদুদ) যেভাবে বলছেন আমি ঠিক সেভাবে বলি নাই। আমি ওনার দুই বছর আগে আরেক ঘটনা নিয়ে কথা বলেছি। আমি বলেছিলাম যে আমিও কম দামি মোবাইল ব্যবহার করি।
তিনি বলেন, অভিযোগকারি তার অভিযোগটা চার-পাঁচ লাইনে লিখেছেন। তাই আমি বলেছিলাম তিনি যেন আবার এসে ভালো করে অভিযোগটা লিখেন। আমি তার জন্য রাত তিনটা পর্যন্ত থানায় অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু তিনি আসেন নাই।
ওসি ইফতেখার হাসান সাদা পোশাকে পরার বিষয়ে বলেন, আসলে রাতের বেলা দেখে পুলিশের পোশাক পরিনি। তাই সাধারণ পোশাকে ছিলাম। এতো রাতে পোশাক পরে থাকার দরকার ছিল না।
মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হলেন মো. জুয়েল রানা বলেন, আমরা ফোনটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। ইতোমধ্যে একজন আসামিকে ধরা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বাকি ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করতে।
এদিকে ভুক্তভোগীর সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানার দুই পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড করা হয়েছে বলে জানান এডিসি জুয়েল রানা।