মাইলস্টোন দুর্ঘটনা : ট্রমায় আক্রান্ত শিশু ও পরিবারের করণীয়

রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাম্প্রতিক বিমান দুর্ঘটনার পর শুধু আহত বা নিহতরাই নন, বরং তাদের আশপাশে থাকা অনেক মানুষও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এই ট্রমা বা মানসিক আঘাতের ফলে তাদের মধ্যে নানা আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবিন হক।
এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে গণমাধ্যম ও আশপাশের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়েও কথা বলেন তিনি। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন ফখরুল শাহীন।
মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মেহজাবিন হক বলেন, এ ধরনের ঘটনায় আক্রান্তদের মধ্যে খিটখিটে মেজাজ, অতিরিক্ত আবেগ প্রবণতা, অমনোযোগিতা বা অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এজন্য তাদের উপর কোনো চাপ দেওয়া যাবে না। বরং তাদের সাথে ভালোব্যবহার করতে হবে।
সামষ্টিক কাউন্সেলিং প্রয়োজন
ড. মেহজাবিন পরামর্শ দিয়েছেন, ট্রমা বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীদের সহায়তায় স্কুলপর্যায়ে সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে। তবে সেমিনারের ধরন নির্ধারণ করতে হবে অংশগ্রহণকারীদের ট্রমার মাত্রা অনুযায়ী। শিশুদের মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা জরুরি।
তিনি বলেন, আহতদের অধিকাংশই শিশু। তাই তাদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং মানসিক স্থিতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। যেকোনো জোরে শব্দ তাদের নতুন করে আতঙ্কিত করতে পারে। এ সময় তাদের পাশে থাকতে হবে, বুঝিয়ে বলতে হবে যে তারা এখন নিরাপদ।

অভিভাবকদের জন্য বার্তা
পরিবারের প্রতি তিনি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, অনেক সময় অভিভাবকরা নিজেদের দোষ দেন, ‘আমি কেন ওকে স্কুলে পাঠালাম’, ‘আমার পাপের শাস্তি, খোদা আমি কি এমন পাপ করেছি’— এসব বলা বা ভাবা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে— এমন ঘটনা ঘটবে আমরা কেউ জানতাম না।
শিশু যদি এখন ওই স্কুলে পড়তে না চায় বা এখনই স্কুলে যেতে না চায় তাকে জোরাজুরি না করারও আহব্বান জানান তিনি।
ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ইতিবাচক স্মৃতি গঠনের গুরুত্ব
ড. মেহজাবিন বলেন, সৃষ্টিকর্তা সহ্য করার শক্তি দিয়েছেন বলেই হয়তো আপনার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে— এটা ভাবতে হবে। নিজেকে কোনোভাবেই পাপী ভাবা বা দোষারোপ করা যাবে না।
শিশু ও পরিবারের মধ্যে ধীরে ধীরে ইতিবাচক স্মৃতি তৈরি করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, তবে সেটা জোর করে নয়। এমন কথা বলা যাবে না— 'ওই স্কুলেই তোকে পড়তেই হবে।' কোনো জিনিস চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
গণমাধ্যম ও আশপাশের ভূমিকা
ঘটনাস্থলে নিহতদের স্মরণে কিছু করা যেতে পারে, তবে তা যেন বেঁচে থাকা বা আহতদের ট্রমা বাড়িয়ে না তোলে সেই আহ্বান জানান তিনি। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের উদ্দেশে বলেন, অনেকে মন্তব্য করেন, ‘ওই বাচ্চাটাই তো ছিল’— এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাও বলা যাবে না। এতে তার মানসিক ক্ষতি বাড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, শিশু বা পরিবারকে জোর করে কিছু জিজ্ঞেস করা, যেমন কীভাবে ঘটল, তুমি কোথায় ছিলে, কী অনুভব করছ— এ ধরনের প্রশ্ন থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে তারা আরও নেতিবাচক স্মৃতি ধারণ করতে পারে, যা বড় ধরনের মানসিক বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।
গণমাধ্যমের প্রতি ড. মেহজাবিন অনুরোধ জানিয়ে বলেন, সাংবাদিকদের উচিত সংবেদনশীলতা বজায় রেখে সংবাদ প্রকাশ করা। ছবি ও ভিডিও ব্লার করে দেওয়া এবং ট্রমাটাইজড পরিবার বা শিশুদের ব্যক্তিগত প্রশ্ন না করা। এগুলো অস্থিরতা বাড়াতে পারে। পরিবারকে ট্রমাটাইজড করে ফেলে।