৫ আগস্ট পুলিশের বীভৎসতার বর্ণনা দিলেন অধ্যাপক ইয়াসমিন

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখারপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্যদের গুলিতে শিক্ষার্থী আনাসসহ ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় দ্বিতীয় দিনের সাক্ষীর জবানবন্দিতে শেখ বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্রাজ্যুয়েট কলেজের অধ্যাপক আয়ারা ইয়াসমিন পুলিশের বীভৎসতার বর্ণনা তুলে ধরে বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হাজার হাজার আন্দোলনকারী এবং কোমলমতি শিশুদের হত্যা ও আহত করা হয়েছে। আমি তাদের বিচার চাই।
আজ মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলায় সাক্ষ্য প্রদানকালে এসব কথা বলেন অধ্যাপক আয়ারা ইয়াসমিন। এ সময় কাঠগড়ায় কনেস্টেবল সুজনসহ চার আসামি উপস্থিত ছিল।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমার নাম আয়ারা ইয়াসমিন। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৪৮ বছর। আমি পেশায় শিক্ষক। আমি ঢাকা শহরের নাজিম উদ্দিন রোডে অবস্থিত শেখ বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।’
আয়ারা ইয়াসমিন বলেন, ‘১৬ জুলাই ২০২৪ এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আমাদের কলেজের বহু ছাত্র-ছাত্রী চানখারপুল মোড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। ঐদিন বেলা ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের একটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের দিকে আর রাস্তার অপর পাশে নাজিমুদ্দিন রোডের দিকে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা অবস্থান করছিল। তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে আমাদের কলেজের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ইব্রাহীম নিরবকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং আমাদের কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র শোভন নিউমার্কেট এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এ ঘটনা আমি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি। এরপর থেকে আমি এই আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন প্রদান করি। এরপর ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেওয়া হয়।’
অধ্যাপক আয়ারা ইয়াসমিন বলেন, ‘এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা বিভিন্ন কর্মসূচিতে আমাদের কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে এবং আমি বিভিন্নভাবে তাদের খোঁজখবর নেই। আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দ্রোহের মিছিল, বিক্ষোভ মিছিল, গ্রাফিতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চলে। এতে আমি নিজেও অংশগ্রহণ করি।’
‘গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখ সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টায় সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমার বাসা চানখারপুল মোড়ে। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পুলিশ মাইকে স্থানীয় লোকজনকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করছে। তখন কারফিউ চলছিল। ঐ দিন আন্দোলনকারীদের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ছিল। আমি আমার ছাত্রদের ফোন করে কর্মসূচির বিষয়ে জানতে পারি—তারা শহীদ মিনারে প্রবেশের চেষ্টা করছে। পুলিশ তাদেরকে শহীদ মিনারে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। আমি আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে বাসার ছাদে উঠে দেখি, চানখারপুল মোড়ে ছাত্র-জনতা সবাইকে বের হয়ে আসার জন্য আহ্বান করছিল। ঐ সময় পুলিশের কয়েকটি গাড়ি আসে এবং গুলি করতে থাকে। তখন আন্দোলনকারীরা হোসেনী দালান রোড, নাজিমুদ্দিন রোডসহ আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নেয়। পুলিশ বিভিন্ন দিকে থাকা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে অনবরত গুলি ছুড়তে থাকে। আমি দেখতে পাই, আনুমানিক সাড়ে ১২টা-১টার মধ্যে চানখারপুলের নিমতলি গলির বাকরখানি দোকানের সামনে একটি ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায়। তারপর আন্দোলনকারীরা তাকে অটোরিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ আগে আমি নবাব কাটরা গলির রাস্তায় রক্ত দেখতে পাই’, যোগ করেন অধ্যাপক ইয়াসমিন।
আয়ারা ইয়াসমিন বলেন, ‘ছাদে আমার সঙ্গে থাকা একজন বলে, পুলিশের গুলিতে সেখানে একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে, এগুলো তার রক্ত। আমি আমার বাসার ছাদ থেকে ঐ দিনের বেশ কিছু ঘটনা আমার মোবাইলফোনে ভিডিও ধারণ করি। সন্ধ্যার দিকে আমি বোরহানউদ্দিন কলেজে যাই এবং সেখানে গেটের সামনে রক্ত দেখতে পাই। পরে জানতে পারি, সেখানেও একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি পরবর্তীতে জানতে পারি, আমার কলেজের অনেক ছাত্র-ছাত্রী এই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে।’
‘আমি পত্রপত্রিকা, টিভি নিউজ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি—তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারসহ অন্যান্যদের নির্দেশে গুলি চালনার ঘটনা ঘটেছে। যেভাবে হাজার হাজার আন্দোলনকারী ও কোমলমতি শিশুদের হত্যা ও আহত করা হয়েছে, আমি তার বিচার চাই’, যোগ দেন আয়ারা ইয়াসমিন।
অধ্যাপক আয়ারা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমি যে মোবাইলফোনে ঐ ঘটনার ভিডিও ধারণ করেছিলাম, সে মোবাইলফোনটি তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ করে এবং পেনড্রাইভে ভিডিওর কপি নেয়। মোবাইলফোনটি আমার জিম্মায় ফেরত দেওয়া হয়েছে। এই সেই জব্দতালিকা (প্রদর্শনী-৬) এবং এতে ইহা আমার স্বাক্ষর (প্রদর্শনী-৬/১)। এই সেই জিম্মানামা (প্রদর্শনী-৭) এবং এতে ইহা আমার স্বাক্ষর (প্রদর্শনী-৭/১)। ইহা জব্দকৃত আমার সেই মোবাইল আইফোন ১৩ প্রো ম্যাক্স (বস্তু প্রদর্শনী IV)। ইহা আমার ধারণকৃত ভিডিও সম্বলিত পেনড্রাইভ (বস্তু প্রদর্শনী V)।’ এ সময় ট্রাইব্যুনালের সম্মুখে ধারণকৃত উক্ত ভিডিওটি প্রদর্শিত হয়।
আয়ারা ইয়াসমিন বলেন, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই হলো আমার জবানবন্দি।’
আজ মঙ্গলবারও সাক্ষ্যগ্রহণ উপলক্ষে চার আসামিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এ চারজন হলেন—শাহবাগ থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। এদিকে সাবেক ডিএমপি কমিশনারসহ অপর চার আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন।
গত ৩ জুন পলাতক চার পুলিশ কর্মকর্তাকে হাজির করতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। গত ২৫ মে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখারপুলে গুলি করে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ২৫ মে এ মামলায় আট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
গত ১৪ জুলাই এ মামলায় পলাতক চার আসামিসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ৫ আগস্ট চানখারপুল এলাকায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালায় পুলিশ। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এতে শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদী হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক নিহত হন।