নঈম মিয়ার হাটে মহিষের দুধের ‘টক দই’

আবহমান বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘টক দই’। জামালপুরে মহিষের দুধ দিয়ে তৈরি ‘টক দই’ বিশেষ খ্যাতি পেয়েছে। কৃষকের ঘরে লালিত-পালিত মহিষের দুধে একেবারে সনাতন পদ্ধতিতে হাতে তৈরি সুস্বাদু এই টক দই বেশ স্বাস্থ্যকর।
মহিষের টক দইয়ের জন্য বকশীগঞ্জ উপজেলার নঈম মিয়ার হাটের পরিচিতি জেলার গণ্ডী পেরিয়ে দেশের নানা প্রান্তে। সপ্তাহের দুই দিন বসে এই হাট, দইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও আশপাশের জেলার দূরদুরান্ত থেকে মুখরোচক এই দই কেনার জন্য হাটের দিন ক্রেতারা ভিড় করেন। সব বয়সের মানুষের জন্য উপাদেয় ও সুলভ মূল্যের কারণে টক দই বিক্রিও ভালো হয়।
নঈম মিয়ার হাটের ‘টক দই’ বেচাবিক্রি ইজারামুক্ত এবং ক্রেতা সমাগম বেশি হওয়ায় ও চাহিদামতো দামের কারণে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই সন্তুষ্ট। মহিষ লালন-পালন ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দই উৎপাদনের জন্য উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।
বকশীগঞ্জে মহিষ পালন করা হয়। মহিষের দুধের চেয়ে দইয়ের চাহিদা ব্যাপক হওয়ায় এ অঞ্চলে মহিষ লালন-পালনে প্রসার ঘটেছে। কোনো খামার নয় কৃষকের বাড়িতে ও গ্রামীণ পরিবেশে পথে-প্রান্তরে সাধারণভাবেই মহিষ চরানো হয়। এসব মহিষ থেকে খুবই উৎকৃষ্ট মানের দুধ উৎপাদন করা হয়, যা টক দইয়ের প্রধান উপকরণ।
কৃষকের বাড়িতেই সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদন করা হয় পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এই ‘টক দই’। স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মহিষের দুধ দোহন করার পর তা ঠান্ডা কারার জন্য পাত্রের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়। দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে গরম দুধ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আসার পর শুরু হয় দই তৈরির প্রক্রিয়া। মাটির হাঁড়ি বা পাতিলে রেখে মাটির ঢাকনা দিয়ে ঢেকে কৃষকের ঘরেই রেখে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় ২৪ ঘণ্টায় কোনো ধরনের রাসায়নিক ও রং ছাড়াই তৈরি হয় ‘মহিষের টক দই’।
আকার অনুযায়ী প্রতিটি মাটির পাত্রে ২ থেকে ১৫ কেজি পর্যন্ত দই তৈরি হয়। প্রতি কেজি দই উৎপাদনে এক লিটারের কিছুটা বেশি দুধের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি মহিষ থেকে চার থেকে ১০ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়। প্রতি কেজি দই বিক্রি হয় ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবে এই টক দইয়ের গুণগত মান এক সপ্তাহ পর্যন্ত বজায় থাকে।
নঈম মিয়ার হাটে উপজেলার সারমারা টাকিপাড়া এলাকার দই বিক্রেতা দোজাহান ব্যাপারী (৫০) বলেন, প্রতিটি মহিষের খাদ্য বাবদ প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। একটি মহিষ ১০ কেজি করে দুধ দেয়। প্রতি লিটার দুধের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা, কিন্তু এই অঞ্চলের কেউ মহিষের দুধ বিক্রি করে না। সবাই দই বানিয়ে বিক্রি করে। এখন প্রতি কেজি দই বিক্রি হয় ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। আমি প্রতি হাটে ২০ থেকে ২৫ কেজি দই বিক্রি করি।
উপজেলার বাঙ্গালপাড়া এলাকার লোকমান (৪০) বলেন, আমার দুটি মহিষ আছে, প্রতিদিন প্রায় ২৩ লিটার করে দুধ পাই। দুধ বিক্রি করি না, সম্পূর্ণ দুধ দিয়ে দই বানাই। নঈম মিয়ার হাট ছাড়াও বকশীগঞ্জসহ অন্যান্য বাজারে দই বিক্রি করি। আজ ২০ কেজি দই হাটে আনছি।
জাহিদ মিয়া, আক্কাস আলীসহ আরও কয়েকজন দই বিক্রেতা বলেন, মহিষ লালন-পালনসহ দই উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণে সরকার যদি উন্নত প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা দেয় তাহলে আমরা ব্যবসার আরও প্রসার ঘটাতে পারব।
ময়মনসিংহ থেকে নঈম মিয়ার হাটে দই কিনতে এসেছেন লুৎফর রহমান (৪০)। তিনি জানান, বন্ধুদের মাধ্যমে টক দইয়ের সন্ধান পাই। আমি এই প্রথম এখানে দই কিনতে এসেছি। ১৫০ টাকা কেজি দরে দই কিনেছি।

যার নামে হাট সেই নঈম মিয়ার নাতি সূর্যনগর এলাকার বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম (৬০) এসেছেন দই কিনতে। তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, দই হাটের বয়স প্রায় ৭০ বছর হবে। মাঝে মাঝেই হাটে এসে দই কিনি। আজ দাম একটু বেশি। শীতের সময় ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে দই বিক্রি হয়। এখন ১৪০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
নঈম মিয়ার হাটের ইজারাদার মহসীন আলী রিপন জানান, সপ্তাহের প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার হাট বসে। শুরু থেকেই দই হাটটি ইজারামুক্ত।
বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, মহিষের টক দই একটি স্বাস্থকর খাবার। মহিষের দুধ উচ্চ প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ, যা গরুর দুধের তুলনায় বেশি। দইয়েও এসব উপাদান বিদ্যমান থাকে। এটি হাড় ও দাঁতের গঠন মজবুত করে। মহিষের টক দইয়ে থাকা প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া হজমশক্তি বাড়ায়, অ্যাসিডিটি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, দইয়ে থাকা ল্যাক্টোব্যাসিলাস জাতীয় উপকারী ব্যাকটেরিয়া শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, যদিও মহিষের দইয়ে চর্বির পরিমাণ বেশি, তবুও এটি খেলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা অনুভব হয়, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। এ ছাড়া ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. ছানোয়ার হোসেন বলেন, বকশীগঞ্জে অনেকেই মহিষ পালন করে। তারা মহিষের দুধ থেকে ‘টক দই’ তৈরি করেন। উপজেলার নঈম মিয়ার হাটে এই দইয়ের বাজার বসে। ওই এলাকায় যারা মহিষ পালনকারী আছেন তাদের আধুনিক পদ্ধতিতে মহিষ লালন-পালনের বিষয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করব। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা যেন টক দই উৎপাদন করতে পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশের অভ্যন্তরেই টক দইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকায় দই বিপণন নিয়ে কোন সমস্যা নেই। যদি কোনো উদ্যোক্তা বড় আকারে উৎপাদন করতে চায়, বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমরা অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের সমন্বয় করে দিব।