প্রতিবছর ২০ লাখ লোককে করের আওতায় আনতে হবে : ড. ফরাসউদ্দিন

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেন, প্রতিবছর ২০ লাখ লোককে করের আওতায় আনতে হবে, যেন যারা কর দিচ্ছে শুধু তাদের উপরই করের বোঝা না পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ পাচারকারীদের ধরার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। তিনি বলেন, ঢালাও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা খুব বেশি ভালো কাজ নয়।
গতকাল মঙ্গলবার পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) আয়োজিত ‘মান্থলি ম্যাক্রোইকোনমিক ইনসাইটস’র (এমএমআই) জুলাই-আগস্ট সংস্করণের প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরাসউদ্দিন এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের সভাপতি ও পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. খুরশিদ আলম উদ্বোধনী বক্তব্য দেন। এতে অংশ নেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, কূটনীতিক এবং বেসরকারি পর্যায়ের নেতারা।
ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, দেশ থেকে বছরে গড়ে ৭০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। পাচারকারীদের ধরতে গিয়ে এক সময় আমার চাকরি যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই সরকার অনেক ভালো ও সাহসী কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং কাস্টমস থেকে পাচারকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। সবাইকে আশাবাদী হতে হবে।
ঢালাও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা খুব বেশি ভালো কাজ নয় মন্তব্য করে ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, অ্যাকাউন্ট জব্দ চিহ্নিত পাচারকারীদের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। তাদের স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা যদি স্বতন্ত্র হয়, তাদের অ্যাকাউন্ট জব্দ করা ঠিক হবে না। এতে আস্থার ঘাটতি তৈরি হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ খুব অল্পের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একমাত্র কাজ হলো নীতি নির্ধারণ করা জানিয়ে ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, তবে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে তারা ঋণ দিতে আগ্রহী। এটি আলাদা করতে হবে। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ৯ বিলিয়নের জিডিপি থেকে এখন চার হাজার ৫৯০ বিলিয়নের জিডিপি হয়েছে। ওই সময়ে মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলার। এখন দুই হাজার ৭০০ ডলার। ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। এই চলার পথে বিভিন্ন অসংগতি দেখা দিয়েছে।
দেশকে এগিয়ে নিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো জানিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, কেন মাত্র ৪০ লাখ লোক কর দেবে, এক কোটি মানুষ কেন দেবে না। প্রতি বছরে ২০ লাখ লোককে করের আওতায় আনতে হবে। ক্ষুদ্র, কুটির ও অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের চিহ্নিত করে প্রশিক্ষণ এবং অতি অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এটি করতে পারলে কর্মসংস্থান হবে, বৈষম্য কমবে এবং দারিদ্র্য নিসরন করা যাবে।
উদ্বোধনী বক্তব্যে ড. খুরশিদ আলম বলেন, বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি চ্যালেঞ্জ। টেকসই সামষ্টিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে তিনি গভীরতর সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
মূল উপস্থাপনায় পিআরআইর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, সংকোচনমূলক নীতি ও ব্যাংক খাতে সুশাসনের মাধ্যমে যে স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে কেবল তখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসনে বিনিয়োগ করা হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ায় আর্থিক অল্পসংখ্যক গোষ্ঠী দায়মুক্তির সঙ্গে অনিয়ম চালিয়ে গেছে, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং জনআস্থা দুর্বল করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া এবং একটি শাসন কাঠামো গ্রহণ করা, যা ইংল্যান্ডের ব্যাংক বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সমতুল্য। এতে আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি. রহমান বলেন, সরকারি, বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বিত পদক্ষেপ ও দৃঢ় সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার ক্লিনটন পবকে বলেন, ব্যাংক, কর ব্যবস্থা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন প্রশাসনিক সংস্কারগুলো দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনতে পারে, যদি এগুলো অব্যাহত থাকে। তবে এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আগামী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। তিনি বলেন, সংস্কারের সুযোগ খুবই বিরল এবং সহজেই হারিয়ে যেতে পারে। তবে বাংলাদেশ তার সংস্কারযাত্রা অব্যাহত রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানের প্যানেল আলোচক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিআইজিইডির ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো খন্দকার শাখাওয়াত আলী বলেন, আমাদের ব্যাংক খাত ক্রমবর্ধমানভাবে প্রযুক্তি গ্রহণ করছে, যা একটি ইতিবাচক প্রবণতা। তবে এই খাতকে আরও এগিয়ে নিতে হলে সাইবার নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক ও মনিটরিং কার্যক্রমসহ কিছু ক্ষেত্রের দক্ষ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে আরেক আলোচক ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান-উর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এর দায়িত্ব তদারকির জন্য একটি পৃথক কমিশন গঠন করা আবশ্যক।