রেডিও জকি, কথা বলাই যখন পেশা

রেডিও জকি পেশাটি যেন আজ তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন। ঠিক যে সময়টাতে আড্ডাবাজি, মাস্তি, পার্টি ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না সে ছাত্রজীবনে রেডিও জকির মতো কাজ আর কী হতে পারে! রেডিও জকি পেশাটা এখন তরুণদের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় যে এখানে কাজ করে যাচ্ছে অনেকগুলো প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। যেমন : জবস এ ওয়ান ডট কম, যেখানে ছয় থেকে আট হাজার টাকা খরচ করলেই করে নেওয়া যায় একটি কোর্স। রেডিও টুডে মিডিয়া একাডেমিতে অবশ্য আনুমানিক ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয় এ কোর্সটি করার জন্য। এবং প্রশিক্ষণ দিচ্ছে রেডিও টুডেরই আরজেরা। অবশ্য এ কোর্স ফি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকম হতে পারে। এ ছাড়া নামকরা আরজেরা ট্রেনিং দিচ্ছেন বিভিন্ন সংবাদ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে। যেখানে উপস্থাপনা, সংবাদ পঠনের পাশাপাশি এখন দেওয়া হয় রেডিও জকির ট্রেনিং। এ ছাড়া সব ভার্সিটিতেই বিভিন্ন কালচারাল ক্লাবেও দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ।
রেডিও জকি হতে হলে কতগুলো বিষয়ে পারদর্শী হওয়া খুবই জরুরি। তাকে অবশ্যই সুন্দর করে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় কথা বলতে জানতে হবে, যার কথা শুনলে অসম্ভব মন খারাপ একজন মানুষের মনও ভালো হয়ে যায়। সে যখন গুড মর্নিং বলবে, তখন তার এনার্জিটিক ভয়েস শুনে চাঙ্গা বা চনমনে হয়ে যাবে সবাই, বিকেলের বিন্দাস আড্ডাও সে-ই মাতাবে, হয়তো সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে লং ড্রাইভে তারই প্লে করা গান শুনতে শুনতে, তারই প্লে করা গান শুনে শ্রোতা মধ্যরাতে একটু প্রেমবিলাসী বা আনমনা হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। এ ছাড়া তার মৌলিক কিছু গুণাবলি যেমন তার গলার স্বর, সেনস অব হিউমার, সাম্প্রতিক বিশ্ব সম্পর্কে জানা, একাল-সেকাল সবকালেরই গান শোনার অভিজ্ঞতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে বিভিন্ন রেডিও স্টেশনের গান এবং হিটশো শুনে সব আরজের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে নিজের একটি স্বকীয় স্টাইল তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ।
এ ছাড়া হালের দর্শক জনপ্রিয় গান থেকে শুরু করে গায়ক অথবা গায়িকা সবারই পছন্দ অথবা অপছন্দ বা বিশেষত্বের জায়গাটিও জেনে নিতে হয়। যেটা তাদের সঙ্গে লাইভ শো করতে গেলে জেনে রাখাটা জরুরি। আর মানবিক গুণাবলির মধ্যে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ যে তাকে বন্ধুবৎসল হতে হবে, রিমঝিম বৃষ্টির শব্দই হোক অথবা রোদের প্রখর উত্তাপই হোক, নিটোল ভালোবাসার গল্প অথবা হৃদয় পোড়া কাব্য, জীবনযুদ্ধে থেমে যাওয়া মানুষ অথবা দিগ্বিজয়ীর গল্প এই সকল অনুভূতিকে কথামালায় গাঁথতে জানতে হবে। জীবনের স্পিডবোটে আমরা সবাই ছুটে চলেছি অনুভূতির ঢেউ পাড়ি দিয়ে। আর এই অনুভূতির গুচ্ছমালা নিয়েই খেলতে হয় একজন রেডিও জকিকে। তাই এতটুকু মানবিক এবং সৃজনশীল হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই অনুভূতি নিয়ে খেলতে পারাও চর্চা এবং সৃজনশীল ভাবনার এক সম্মিলিত রূপ।
তাই রেডিও জকি হিসেবে কেউ যদি ক্যারিয়ার শুরু করতে চায়, তবে তার কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক করার অভিজ্ঞতা, অথবা অন্য যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজ যা কথাশিল্পের সঙ্গে জড়িত সেগুলো যদি সিভিতে উল্লেখ থাকতে হবে। আবার অনেকেই কলেজ চ্যাম্পিয়ন বা এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত; তো এ রকম দু-একটা অ্যাওয়ার্ড যদি ঝুলিতে থাকে তবে সেটাও সিভিতে উল্লেখ করা যেতেই পারে। আর আমাদের সবারই তো কিছু না কিছু শখের পাগলামি থেকেই যায় যেমন : আড্ডা দেওয়া, গল্পের বই পড়া, গিটার বাজানো অথবা প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে বৃষ্টিতে ভেজা-এই পাগলামিগুলোও যদি একজন রেডিও জকির সিভিতে উল্লেখ থাকে তবে সেটাও বাড়তি কিছু যোগ করবে। এ সবকিছুর সঙ্গে যদি অডিও মিডিয়ার কিছু গ্রামার যেমন : ইনফো লিংক, সং লিংক, মিউজিক লিংক, বেড, টপ অব দ্য আওয়ার, ইনট্রো লিংক, এক্সট্রো লিংক, ভক্স পপ, ফোনো লাইভ, রেগুলার শো, স্পেশাল শো, প্রোমো, কনসোল এগুলো সম্পর্কে ট্রেনিং নিয়ে নেওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই-একেবারে সোনায় সোহাগা। পাশাপাশি যদি এখনকার পপুলার সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কে যেমন : ফেসবুক, টুইটার, ওয়াটস এ্যাপ, ভাইবারে থাকে দখল তাহলেই বাজিমাৎ।
অর্থাৎ রেডিও জকি হতে হলে সেনসিবল, টেকনিক্যাল, ক্রিয়েটিভ, স্মার্ট একটা প্যাকেজ হতে হয়। আমাদের এখন বাংলাদেশ বেতারের পাশাপাশি আছে বিভিন্ন বেসরকারি রেডিও চ্যানেল। এর মধ্যে হিট লিস্টে রেডিও টুডে এফএম ৮৯.৬, রেডিও ফূর্তি ৮৮.০এফ এম, রেডিও এবিসি ৮৯.২, ঢাকা এফ.এম ৯০.৪, পিপলস রেডিও ৯১.৬ অন্যতম। এ ছাড়া সিটি এফএম, কালারস এফএম, রেডিও নেক্সট, রেডিও সেভেনটি ওয়ান রয়েছে। আরো কয়েকটি রেডিও স্টেশন রয়েছে ফ্রিকোয়েন্সির অপেক্ষায়।
এই রেডিও স্টেশনগুলোর হিউম্যান রিসোর্স ডিভিশনে গিয়ে সিভি জমা দিয়ে অথবা আরজে হান্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেই হওয়া যায় পছন্দের স্টেশনের আরজে। অথবা মাঝেমধ্যেই চাকরির সার্কুলারেও চোখে পড়ে রেডিও জকির বিজ্ঞাপন। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে একেবারে কাঠখোট্টা একটা কর্মপরিবেশকে বাদ দিয়ে বরং আনন্দের সঙ্গে গান শুনে অথবা শখের আড্ডাবাজি করে কাজ করতে কে না চায়! যেখানে অনএয়ার রুমের হট সিট থেকে শুরু করে অফএয়ার রুমের প্রোমো অথবা কমার্শিয়াল-সব জায়গাতেই রাজত্ব একজন রেডিও জকির। যদি কেউ অডিও মিডিয়াতেই থাকতে চায় তবে সাউন্ডিংয়ে, প্রোগ্রাম প্লানিং এবং টেকনিক্যাল কাজ শিখে হয়ে যেতে পারে। ফুলটাইম প্রডিউসার, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, স্টেশন ম্যানেজার বা অপারেশন হেড হওয়ারও সুযোগ রয়েছে রেডিওতে।