আবারও পড়ো
হুমায়ূন আহমেদের বোতলভূত
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/10/06/photo-1475737118.jpg)
ছোটবেলায় হুমায়ূন মোটেই ভালো ছাত্র ছিল না। ক্লাসের বত্রিশ জনের মধ্যে ক্রমিক নম্বর ছিল ৩২। তবে ওদের ক্লাসে যে ছেলেটা একদম কথা বলে না—মুনির, ও কিন্তু খুব ভালো ছাত্র। গণ্ডারের ইংরেজি বলতে বললে চট করে বলে দিতে পারবে। শুদ্ধ বানানে।
একদিন অঙ্ক ক্লাসে হুমায়ূন খুব মার খেল। দোষ কিছুই না। স্যার ক্লাসে অঙ্ক কষতে দিয়েছিলেন। হুমায়ূন মুনিরেরটা দেখে দেখে চট করে কষে ফেলল। কিন্তু ক্লাসে তো আর কেউ সেই কঠিন অঙ্ক করতেই পারেনি। হুমায়ূন অঙ্ক করা শেষে হাত তুলে বসে আছে, ক্লাসে আর কেউ হাত তুলল না। মুনির তো হাত তুললই না। ও তো কথাই বলে না, তার ওপর হাত তোলা! হুমায়ূন ধরা পড়ে গেল। শাস্তি হলো, পঁচিশ ঘা বেত। মুনির কিন্তু একটাও বেতের ঘা খেল না। ও যে ভালো ছাত্র। দোষের মধ্যে শুধু কথা বলে না।
তবে এতে হুমায়ূনের একটা মজা হলো। মুনির নিজে থেকেই ওর সঙ্গে কথা বলল। হুমায়ূনকে জিজ্ঞেস করল, ভূত পুষবে নাকি?
শুনে তো হুমায়ূনের আক্কেলগুড়–ম! ভূত পুষবে মানে? ভূত কি কুকুরছানা নাকি? মুনির বলল, ওকে নাকি একজন ভূতের বাচ্চা দেবে। সন্ধ্যার সময় যেতে হবে। হুমায়ূনও সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। শর্ত একটাই, কাউকে বলা যাবে না।
যেখান থেকে ভূত আনতে হবে, সে অনেক দূরের পথ। ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে গাছপালায় ঢাকা জঙ্গলে এক জায়গায় শেওলাঢাকা এক বাড়ি। লোহার গেট। সেই গেটে বাড়ির নাম লেখা—শান্তিনিকেতন। মুনিরের কোনো এক দূরসম্পর্কের নানা। লোকটা যেমন অদ্ভুত, দেখতেও তেমনি। অবিকল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠিক সে রকম লম্বা দাড়ি। সাদা বাবড়ি চুল। পরনে আলখাল্লার মতো লম্বা একটা পোশাক। গলার স্বরও কী গম্ভীর। ভেতরে যে ঘরে নিয়ে গেলেন, সেই ঘরটাও অদ্ভুত। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত শুধু বই আর বই। মাঝখানে একটা ইজিচেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। ইজিচেয়ারের পাশে ছোট্ট একটা টেবিল। টেবিলে একটা অদ্ভুত ধরনের টেবিল ল্যাম্প।
সে ঘরে যাওয়ার পর রবিঠাকুরের মতো লোকটা বসলেন ইজিচেয়ারে। আর ওদের বসতে বললেন মেঝেতে। তারপর বললেন আরো অদ্ভুত কথা, ভূতের বাচ্চা যে নিবি, কোনো পাত্র এনেছিস?
ওরা তো কোনো পাত্র আনেনি। পরে রবিঠাকুরের মতো লোকটি কোত্থেকে খুঁজে পেতে একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি নিয়ে এলেন। তাতে করেই দিলেন ভূতের বাচ্চা।
রাতের বেলা ভূতের বাচ্চা পকেটে করে বয়ে বেড়াতে মুনিরের ভীষণ ভয় করছিল। হুমায়ূনকে বলল, রাতের জন্য ভূতের বাচ্চাকে নিয়ে যেতে। পরদিন স্কুলে এসে দিয়ে দিলেই হবে। হুমায়ূন আর কী করবে, পকেটে করে ভূতের বাচ্চা নিয়ে বাসায় ফিরে এলো।
বাসায় যখনই খবর পাওয়া গেল, হুমায়ূন পকেটে করে ভূতের বাচ্চা নিয়ে এসেছে, এলাহি কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। সবাই হোমিওপ্যাথির শিশিটা দেখতে লাগল। পরদিন ক্লাসে অঙ্ক স্যার তো আরো বড় কাণ্ড করে বসলেন। ক্লাস-ক্যাপ্টেনকে দিয়ে এক গ্লাস পানি আনালেন। তারপর হোমিওপ্যাথির বোতলটার মুখ খুলে নিজের মুখে উপুড় করে ধরলেন। তারপর এক গ্লাস পানি খেয়ে বললেন, গিলে ফেললাম। হলো এখন? ভূতের বাচ্চা হজম।
কিন্তু তাই কী আর ভূতের বাচ্চা হজম হয়? এর পর থেকেই স্যারের ঢেঁকুর উঠতে থাকল। পরে অনেক কষ্টে ভূতের বাচ্চাকে স্যারের পেট থেকে বের করতে হলো।
লোকটা কিন্তু ভূতের বাচ্চা সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিল, ওর কাছে মাসে একটার বেশি আবদার করা যাবে না। কিন্তু হুমায়ূনের তো বিশ্বাসই হতে চায় না, ওর এই হোমিওপ্যাথির বোতলে ভূত আছে। সেই ভূত আবার চাইলেই যেকোনো কিছু করে দিতে পারবে।
বৈশাখের ছুটির আগে বড় ভাইয়ারা গিয়েছিল হেডস্যারের কাছে, বৈশাখের ছুটি দুই সপ্তাহ এগিয়ে দিতে। স্যার শুনে উল্টো ছুটি পিছিয়ে দিলেন। ওদের সবার তো মন খারাপ। রাতে ঘুমানোর আগে হুমায়ূন বোতলভূতকে বলল, কাল থেকেই স্কুল ছুটির ব্যবস্থা করে দিতে।
আর কী কাণ্ড, পরদিন অ্যাসেম্বলিতে সোনার বাংলা গান হয়ে যাওয়ার পর হেডস্যার বললেন, স্কুলের জন্য সরকার থেকে দুই লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এখন তোমরা পাবে পাকা দালান। দালানের কাজ শুরু করতে হবে বর্ষার আগেই। কাজেই আজ থেকে তোমাদের গরমের ছুটি। হুমায়ূন তো যাকে বলে হতভম্ব!
এমনি করে বোতলভূত ওদের কত উপকার করে দিতে লাগল। স্কুল ছুটির ঘোষণা দেওয়ার পর হুমায়ূনের বড় চাচা নিয়ম করে দিলেন, সারা দিন পড়তে হবে। ছুটিটা মাটি হতে দেওয়া যাবে না। বোতলভূতকে বলতেই পরদিন বড় চাচা একদম উল্টো কথা বলতে শুরু করলেন।
আবার ফুটবল কম্পিটিশনে হুমায়ূনদের ফুটবল দলটা ছিল পাড়ার সবচেয়ে খারাপ দল। তবে ওদের ফরোয়ার্ড টগর খুবই ভালো খেলে। কোনোভাবে ওর কাছে বল পৌঁছে দিতে পারলেই হলো, ও গোল দিয়ে দেয়। টগর বলতে গেলে একাই ওদের ফাইনালে তুলে দিল। কিন্তু ফাইনালে ওদের জেতার কোনো সুযোগই ছিল না। ফাইনালে ওদের প্রতিপক্ষ বুলেট একাদশ। সে দলের ক্যাপ্টেন বগা ভাই। সে যে কী ভয়ংকর! তার হুমকি শুনে টগর আগেই বলে দিল, ও খেলবে না। দলের আরেকজন যা একটু খেলতে পারত, করিম, ওকেও বগা ভাই ধমকে দিল। ও-ও এসে বলল, খেলবে না। এখন কী করা যায়?
হুমায়ূন বোতলভূতকে বলল জিতিয়ে দিতে। আর কী আশ্চর্য! বুলেট একাদশের কেউ বলে কিক নিলেও বল যায় না। উল্টো হুমায়ূনদের হয়ে বল যেন একা একাই বুলেট একাদশের পোস্টে ঢুকে গেল! হুমায়ূনদের রয়েল বেঙ্গল ফুটবল একাদশ চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল।
এমনি করে হুমায়ূনের দিন ভালোই কাটছিল। বোতলভূতও বেশ বিখ্যাত হয়ে গেল। অরু আপা তো বোতলভূতকে নিয়ে বিশাল গবেষণাও করে ফেলল। কিন্তু অনেক গবেষণা করেও প্রমাণ করতে পারল না যে বোতলটা খালি। শেষমেশ রাগ করে বলল, তোর এই বোতল নিয়ে বিদেয় হ। শুধু শুধু সময় নষ্ট।
তাতে উল্টো হুমায়ূনেরই লাভ হলো। সবাই জেনে গেল বোতলভূতের ব্যাপারটা। নিতান্ত অপরিচিত লোকও পথের মাঝখানে ওকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে, এই যে খোকা, তোমার কাছে বোতলের ভেতর নাকি কী আছে? দেখি জিনিসটা। হুমায়ূনও হাসিমুখে দেখায়। খুব গর্ব হয় ওর তখন। ভূত পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তো খুব সহজ ব্যাপার না। হেডস্যার পর্যন্ত একদিন বললেন, দেখি জিনিসটা?
তবে সব ভালো দিকের একটা খারাপ দিকও আছে। একদিন খারাপ দিকটা স্পষ্ট হলো। স্কুল থেকে ফেরার পথে, কালীতলার মন্দিরটার কাছে বগা ভাইয়ের সঙ্গে ওর দেখা হলো। ওকে দেখেই বগা ভাই থমথমে গলায় বলল, ভূত বের কর। না বের করলে কাদার মধ্যে পুঁতে ফেলব। তার আগে এমন একটা চড় দেব যে বত্রিশটা দাঁত তো পড়বেই, জিব পর্যন্ত পড়ে যাবে।
হুমায়ূন আর কী করবে, বোতল বের করে দিয়ে দিল। বগা ভাই সেই বোতল টপ করে নিজের পকেটে রেখে দিয়ে বলল, আর কোনো কথা না, সোজা বাড়ি চলে যা। একটা কথা বলেছিস তো ছয় নম্বুরি ধোলাই দিয়ে দেব।
হুমায়ূন আর কী করবে? রাগে-দুঃখে ওর চোখে পানি চলে এলো। টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। কিন্তু কী করার! বগা ভাইয়ের সঙ্গে তো আর মারামারি করে পারা সম্ভব না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ও ভেবেছিল, বোতলভূত একা একাই চলে আসবে। অনেক খোঁজাখুঁজি করল ও, পেল না।
ওদিকে বগা ভাইয়ের উপদ্রবও খুব বেড়েছে। একদিন মুনিরকে ধরে ধোলাই দিল। আর ওর অঙ্ক বই কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলল। আরেক দিন হুমায়ূন আর তোতলা রঞ্জুকে পেয়ে কান ধরে ওঠবস করাল। এখন তাহলে উপায়?
উপায় হয় ঠিকই। শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন ঠিকই বগা ভাইকে শায়েস্তা করে। আর ওর প্রিয় বোতলভূতকেও উদ্ধার করে। কীভাবে উদ্ধার হলো? জানতে হলে বইটি পড়ে ফেলতে হবে।
বই : বোতলভূত
লেখক : হুমায়ূন আহমেদ
ধরন : ফ্যান্টাসি
ভাষা : বাংলা
প্রথম প্রকাশ : আগস্ট ১৯৮৯
প্রকাশক : প্রতীক প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ৬৬