ভৈরবে অর্ধশতাধিক জরাজীর্ণ ভবন, ঝুঁকিতে জনজীবন
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বাংলাদেশ সরকারের পৌরসভা ইমারত আইন বা বিল্ডিং কোড-১৯৯৬ অমান্য করে গড়ে উঠছে শত শত বহুতল ভবন। অন্যদিকে প্রাচীনকালের অর্ধশতাধিক পুরনো জরাজীর্ণ ভবনের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে জনজীবন। এসবের কারণে যেকোনো সময় ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। হাজারও মানুষের প্রাণহানিসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদহানির আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
বৃটিশ শাসনামল থেকে ভৈরব নদীবন্দর একটি সমৃদ্ধ জনপদ। বিশাল হাওরাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য আর পাটকে কেন্দ্র করে এখানে ব্যবসার প্রসার হয় ক্রমান্বয়ে। গড়ে ওঠে জনবসতিসহ শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তৈরি হয় বিভিন্ন ভবন। কালের ভারে সেগুলো এখন বেশ পুরাতন, জরাজীর্ণ আর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলেও, সেসব ভববনে এখনও মানুষ বসবাস করছে। চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য।
ভৈরব বাজার নদীরপাড়, লোহাঘাট, গুড়পট্টি, হলুদপট্টি, মরিচপট্টি, টিনপট্টি, নতুনগলি, কাপড়পট্টি, বটতলারোড, চকবাজার, রাণীর বাজার, শাহীমসজিদ রোড, কাচারিমোড় ইত্যাদি সড়ক ও অলিগলিতে এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন জীর্ণতা আর ভগ্নতা নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
শাহী মসজিদ রোড এলাকার ব্যবসায়ী কবির আহমেদ বলেন, ‘প্রতিদিন আল্লাহ-খোদাকে ডেকে দোকানে ঢুকি। বের হয়ে বেঁচে থাকার জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলি। কারণ আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেয়াল ও ছাদের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। খসে খসে পড়ছে প্রলেস্তারা। তবে মালিক খুব শিগগিরই ভবনটি ভেঙে নতুন করে করবেন বলে উদ্যোগ নিয়েছেন।’
পাশের অপর এক ভবনে ব্যবসা করেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আতঙ্ক নিয়ে প্রতিদিন কাটাই। মালিকেরা বলছেন, কিন্তু তারা আশ্বাস ছাড়া আর কোনো উদ্যোগই নিচ্ছেন না।’
ভবনের মালিক চায়না বেগম নিজেও জরাজীর্ণ ওই ভবনের দ্বিতীয়তলায় বসবাস করেন। তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওয়ারিশ নিয়ে আমাদের পরিবারে ঝামেলা চলছে। তাই ভবনটি আপাতত: ভাঙা যাচ্ছে না। এ সমস্যার সমাধান হলে যাদের ভাগে যাবে এই ভবন, তারা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন।’
চকবাজার এলাকার একটি বিশাল তিনতলা জরাজীর্ণ ভবনের মালিকদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ভবনটির ওয়ারিশ আমরা ১৬ জন। আমরা সবাই একমত না হতে পারায় কয়েক কোটি টাকার এই ভবনসহ মূল্যবান জমিটি পড়ে আছে। অথচ সবাই মিলে উদ্যোগ নিতে পারলে আমাদের নিজেরেই অনেক লাভ হতো।’
বটতলা রোডের ব্যবসায়ী সেলিম রেজা, রানীর বাজারের ব্যবসায়ী ও মানবাধিকারকর্মী শাহনোয়াজ গাজী বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ভবন আর বিল্ডিং কোড না মেনে গড়ে ওঠা বহুতল ভবনের কারণে ভৈরবে যেকোনো সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এতে বহুলোকের প্রাণহানিসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতির আশঙ্কা করে তারা অবিলম্বে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ভৈরব বাজার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার মো. আজিজুল হক রাজন জানান, ‘পুরাতন শহর হওয়ায় ভৈরব এমনিতেই খুব ঘনবসতিপূর্ণ। অপ্রশস্ত প্রচুর অলিগলি রয়েছে এখানে। বাণিজ্য ও বন্দর নগরী হওয়ায় আশে পাশের জেলা-উপজেলা থেকে প্রতিদিন প্রচুর লোকজনের আগমন ঘটে। বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মাণ কাজ করায় এখানে আগুন নেভাতে বেশ বেগ পেতে হয়। অনেক সময় এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিং হয়ে পানিবাহী গাড়ি তো বহু দূরের বিষয়, পাইপলাইন পর্যন্ত বহণ করে নেওয়া যায় না। এতে করে আগুন নিভাতে গিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয় দমকল বাহিনীর সদস্যদের। কখনওবা সঠিকভাবে পানির ব্যবহার না করতে পারায় আগুন নেভাতে অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের কারণে জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি বেশি হয়।’
পৌর নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘ভবনগুলো যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটাতে পারে। এই ভবনগুলির বিষয়ে তারা শিগগিরই আইন অনুযায়ী যথাযথ প্রক্রিয়া গ্রহণ করবেন।’
বিল্ডিং কোড না মানা প্রসঙ্গে তিনি জানান, পৌরসভা থেকে প্ল্যান অনুমোদনের সময় পৌরসভা ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৯৬ অনুযায়ীই অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু অনুমোদনের পর নাগরিকরা অনেক ক্ষেত্রে সেই আইন লংঘন করে নির্মাণ কাজ করে থাকে। এ অনিয়ম বিষয়ে পৌর কর্তৃপক্ষ জানার পর ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। অনেকক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জনবল এবং ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার না থাকায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। তিনি যথাযথ আইন প্রয়োগে পৌরসভাতে একটি স্বতন্ত্র নগর পরিকল্পনা ইউনিটের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। পাশাপাশি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তা নিয়োগের কথাও জানান।
পৌরসভার মেয়র আলহাজ ইফতেখার হোসেন বেনু জানান, মেয়াদোত্তীর্ণ পুরাতন বিল্ডিং বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অচিরেই নোটিশ করা হবে। তাতে সাড়া না দিয়ে আইনগতভাবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পৌরসভার ইমারত আইন অমান্য করে বিল্ডিং করছে এমন কয়েকজনকে এরই মধ্যে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। পৌরসভার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে যারা আইন মানবেন না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে।