‘ও মাগো’ চিৎকারে লুটিয়ে পড়েন বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি দিপু সানা
অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলেন দিপু সানা। রাজধানীর শান্তিনগরে বাস থেকে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন মগবাজারের উদ্দেশে। বাসার পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছান নিউ সিদ্ধেশ্বরীর সার্কুলার রোডের ফখরুদ্দিন রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পার্টি সেন্টারের সামনে। ঠিক তখনই ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা। সিমেন্ট ও বালু দিয়ে তৈরি একটি ইট উপর থেকে পড়ে তার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গেই ‘ও মাগো’ বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সেখানেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদরঘাট শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক (এডি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন সানা। গতকাল বুধবার (১০ জানুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ঘটনা সময় ফখরুদ্দিন পার্টি সেন্টারের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, “হঠাৎ ‘ও মাগো’ বলে চিৎকার শুনতে পাই। গেটের বাইরে গিয়ে দেখি এক নারী মাটিতে পড়ে রয়েছেন। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। পাশে একটি বড় ইট পড়ে ছিল। পরে আমি ফখরুদ্দিন রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পার্টি সেন্টারের ম্যানেজার মো. রিয়াজকে ডেকে নিয়ে যাই।”
মো. রিয়াজ বলেন, ‘আমি গিয়েই ওই নারীকে সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করি।’ এসব কথা বলতে বলতে চার তলার ফখরুদ্দিন রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পার্টি সেন্টারের ভবনের ছাদে গিয়ে দেখা যায়, ছাদে কয়েকটি বড় বড় পাথর পড়ে ছিল। ছিল কিছু পরিত্যাক্ত আসবাবপত্র। এ ভবনের আশপাশে কোনো নির্মাণাধীন ভবনও নেই। সে সময় ওই ছাদে পিবিআইয়ের একটি তদন্তকারী দল উপস্থিত ছিল। ভবনের সামনেই মৌচাক ফ্লাইওভার। ওই দলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই ইট কোথা থেকে পড়ছে বা মারা হয়েছে, বুঝতে পারছি না। বিস্তারিত তদন্তে জানা বা বোঝা যাবে।’
ছাদ থেকে নামার সময় রিয়াজ দাবি করেন, ‘ইটটা ফ্লাইওভার থেকেও পড়তে পারে। শুনেছি, পুলিশ ইটটার একটি ভাঙা ক্ষুদ্র অংশ ফ্লাইওভারের ওপর পেয়েছে।’ যদিও, ইটের ক্ষুদ্র অংশ পাওয়ার তথ্য স্বীকার করেননি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
মো. রিয়াজ দাবি করেন, ‘নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত আমাদের রেস্তরাঁ। চার তলায় ভবন মালিকের স্টোর রুম। এ ভবনের ছাদে আমার অনুমতি ছাড়া কেউ উঠতে পারেন না। চাবি থাকে আমার কাছে। গতকাল যখন মাথায় ইট পড়ার ঘটনা ঘটে, তখন নিচ তলার আমার কক্ষে বসে ছিলাম। সে সময় ছাদের গেট বন্ধ ছিল। ওপর থেকে ইট পড়া বা মারার কোনো সম্ভবনা নেই।’
রিয়াজের দাবি, ‘বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন এসে দেখে গেছে ভবনের ছাদ। তারাও কোনো কুলকিনারা পাচ্ছেন না, এই ভেবে যে; অতোবড় ইটটা কীভাবে পড়ল। এ ইটের কোনোরকম ব্যবহার আমাদের ভবনে পায়নি পুলিশ। আশপাশের ভবনেও ওই ইটেরর খোঁজে পুলিশ গেছে। ইটটা কোনো স্বাভাবিক ইট নয়। রাস্তায় ব্লক করে দেওয়ার কাজে সাধারণত এ ধরনের বাঁকা ইট ট্রাফিক পুলিশ ব্যবহার করে থাকেন। এ ধরনের ইটের কোনো কাজও হয় না আমাদের রেস্তোরাঁয়। ভবন মালিক সুলতানের কাছ থেকে আমরা আড়াই বছর ধরে ভাড়া নিয়ে রেস্তরাঁ ও পার্টি সেন্টার চালাচ্ছি।’
ভবনের ছাদ থেকে নিচে নামার পর ভবনের প্রবেশদ্বারে কথা হয় নিরাপত্তাকর্মী হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। এ ভবনে তিন মাস ধরে দায়িত্ব পালন করা হাবিবুর বলেন, ‘গেটটা আমি এক হাতের মতো খুলে রাখছিলাম লোকজন চলাচল করার জন্য। আমি গেটের ভেতরে ছিলাম। হঠাৎ চিৎকার শুনে দৌঁড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি, রাস্তার ফুটপাতে তিনি পড়ে আছেন। মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। ম্যানেজার স্যারকে ডেকে বলি, ওপর থেকে ইট পড়ে এক নারীর মাথায়। ফুটপাতে পড়ে আছেন। তবে, ইটটা কোথা থেকে পড়েছে, তা আমি দেখিনি। আমি যদি গেটের বাইরে থাকতাম, তাহলে দেখতে পেতাম। ইটটা কোন জায়গা থেকে পড়ছে বা কে মেরছে। পরে আমি পানি দিয়ে রক্ত ধুয়ে ফেলি।’
এ ঘটনায় দিপু সানার স্বামী তরুন কুমার বিশ্বাস ৩০২ ধারায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। দিপু সানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৫-২০০৬ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি খুলনার পাইকগাছায়। নিহত সানার তিন বছরের এক সন্তান রয়েছে।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মোফজ্জল হোসেন। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ঘটনার পরপরই আমরা ঘটনাস্থলে যাই। পরে ফখরুদ্দিন পার্টি সেন্টারের ওপরে যাই। এ ছাড়া আশপাশের কয়েকটি ভবনে ও সিদ্ধেশ্বরী কলেজে গিয়ে ইট ছোড়ার বিষয়টি নিশ্চিত হতে চেষ্টা করি। কিন্তু, কোনো হদিস মিলছে না। শুধু পুলিশ নয়, এ ঘটনায় অন্যান্য সংস্থাও তদন্ত করছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা টোকাইসহ ছয় থেকে সাতজনকে আটক করেছি। কিন্তু, কুল-কিনারা করতে পারছি না।’
মোফজ্জল হোসেন বলেন, ‘যে ইটের আঘাতে দিপু সানা মারা গেছেন, সেটি ১০ থেকে ১১ কেজি ওজনের। সিমেন্ট ও বালু দিয়ে তৈরি। এটা ফুটপাত নির্মাণে ব্যবহৃত খাঁজ কাটা ব্লকের মতো। দেখতে ইটের মতো। ফলে, ইটটা অনেক দূর থেকে ছুড়ে মারা সম্ভব না। কিন্তু, এ ইট কোথা থেকে পড়তে পারে, তা আমরা এখনও জানতে পারিনি। আর হাসপাতাল থেকে পাওয়া প্রতিবেদনে স্পট ডেথ উল্লেখ করা হয়েছে।’
ওই ইটের ক্ষুদ্র ভাঙা অংশ ফ্লাইওভার থেকে পাওয়া গেছে কি না, এমন প্রশ্নে রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ জাতীয় তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা এখনও জানতে পারিনি, ইটটা কোথা থেকে পড়তে পারে। তবে, আমরা জোরেসোরে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।’
দিপু সানার এমন মৃত্যু যেন কেউ মেনে নিতে পারছে না। আজ বৃহস্পতিবার সকালে দিপু সানার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়। সেখানে তার স্বামী তরুণ বিশ্বাস, আত্মীয়স্বজন ও উপস্থিত সহকর্মীরা বাকরূদ্ধ হয়ে মরদেহর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন না। সানার স্মৃতি মনে করে নানান কথা বলছিলেন, চোখের জল ফেলছিলেন। তাদের একজন সহকর্মী বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসারস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা শ্রাবণ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ী যারা তাদের চিহ্নিত করা হোক। আইনের আওতায় আনা হোক। আইনি প্রক্রিয়ায়াটা যাতে ঠিকমতো হয়, এটাও আমরা চাই। এই দুর্ঘটনায় অবশ্যই অবহেলা আছে। আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটব, আমি নাগরিক, অবশ্যই আমার নিরাপত্তা চাই। আর এ ঘটনায় যারা যারা দায়ী, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
দিপু সানার চাচা স্বপন কুমার সানা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা বাকরুদ্ধ। একটা মানুষ মৃত্যুর এক সেকেন্ড আগেও জানতেন না, তার ছোট্ট সন্তানের সঙ্গে আর দেখা হবে না। এ মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। কিছু বলার ভাষা নেই আমার।’
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আমার স্ত্রী দিপু সানা (৩৭) বাংলাদেশ ব্যাংক সদরঘাট শাখার ঢাকার সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বুধবার তার অফিস ছুটি হয়। পরে অফিসের বাসে চড়ে আমার বর্তমান ঠিকানায় (বড়মগবাজার) যাওয়ার জন্য শান্তিনগর নেমে যায় সানা। সানা ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পথে সাড়ে ৭টার দিকে রমনা মডেল থানার নিউ সার্কুলার রোড সিদ্ধেশ্বরী ফখরুদ্দিন পাটি সেন্টারের সামনে পৌঁছান। সে সময় অজ্ঞাতনামা আসামি ওপর থেকে সিমেন্ট ও বালু দিয়ে তৈরি একটি ইট হঠাৎ করে আমার স্ত্রীর মাথার ওপর ফেলে। গুরুত্বর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তখন স্থানীয় লোকজন আমার স্ত্রীকে সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।