প্রতিক্রিয়া
আনু মুহাম্মদকে হুমকি কতটা রামপাল-সংশ্লিষ্ট?
রামপালে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণবিরোধী আন্দোলন নেতা এবং তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে হত্যার হুমকি দিয়ে মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা একবার নয়, একই দিনে একাধিকবার ঘটেছে। প্রথমে হুমকিতে হুমকিদাতা(রা) নিজেদের আনসারুল্লাহ (ভুল বানানে) দাবি করলেও দ্বিতীয় হুমকিতে রামপালকে ‘হ্যাঁ’ বলতে নসিহত প্রদান করেছে।
আনু মুহাম্মদ বামধারার রাজনীতির সমর্থক এবং তেল-গ্যাস-বন্দরসহ অন্যান্য আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। এ ধরনের আন্দোলনগুলোর অধিকাংশই সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়ে আসছে বলে সরকার ও তাঁরা সব সময়ই মুখোমুখি অবস্থানে বলে দৃশ্যমান। বাংলাদেশে সরকারবিরোধী মাঠ পর্যায়ের রাজনীতি না থাকার কারণে এ মুহূর্তে কম শক্তির হলেও বামপন্থীরাই সরকারবিরোধী একটা ফ্রন্টে অবস্থান করছে। আর সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে চলমান আন্দোলন বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত ও আনু মুহাম্মদদের জাতীয় কমিটি নেতৃত্ব দিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনায় থাকার কারণে তাঁরাই এ মুহূর্তে সরকারবিরোধী অবস্থানে নিজেদের উজ্জ্বল করে রেখেছেন।
রামপালকে ‘না’ বলার এ আন্দোলনের নেতৃত্ব বামপন্থীদের হাতে থাকলেও দেশের সুস্থ চিন্তার অনেক লোকই রামপালে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। এ দলে অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থকও আছেন। ফলে বলা যায়, রামপালকে ‘না’ বলার আন্দোলন কেবল বামপন্থীদের আন্দোলন কিংবা সরকারবিরোধী আন্দোলনই নয়; এটা সর্বজনীন এক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
আওয়ামী লীগের বাইরে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিও রামপালে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ‘মেকশিফট বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টির স্বতন্ত্র কোনো বক্তব্য রাজনীতিতে দৃশ্যমান না থাকার কারণে তারা কোনো পক্ষেই নেই। আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ, যারা সরকারি আওয়ামী লীগের সমর্থক, তারা কেবল এ দাবিকে সমর্থনই করছে না, যেকোনোভাবে সরকারি এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নিজেদের অবস্থানে থেকে কাজও করছে।
রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ মূলত ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ দাবিকে উপজীব্য করে এগিয়ে চলছে। দেশে বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু উন্নয়ন কিংবা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়ার অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তকে তাই সরকারি আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ সমর্থন করছে না। এমন অবস্থায় সরকারের মন্ত্রী-এমপি-প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে নিয়ত রামপালের পক্ষে প্রচারণা চলছে। একই সঙ্গে অন্যান্য গণমাধ্যমেও এ নিয়ে প্রচারণা চলছে অর্থসংযোগে। ফলে ধারণা করা যায়, সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে মরিয়া।
এমন অবস্থায় সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। এমনকি নিরীহ এক সাইকেল র্যালিতে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে, পুলিশ জলকামান ছুড়েছে, লাঠিচার্জ করেছে।
‘রামপালকে না’ তথা ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে দুর্বল বামপন্থীদের নেতৃত্ব ও সচেতন সাধারণ মানুষের সমর্থনে এগিয়ে চলেছে। এমন অবস্থায় জাতিসংঘের ইউনেস্কোও রামপালে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে তাদের আপত্তি জানিয়েছে। ইউনেস্কোর আপত্তিসংবলিত চিঠির পর ফের নড়েচড়ে বসেছে সরকার এবং এর জবাব দিতেও যাচ্ছে তারা। ফলে ধারণা করা যায়, সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলন অনেকটা সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
রামপালবিরোধী আন্দোলন, ইউনেস্কোর জবাব এবং সরকারের পরবর্তী সিদ্ধান্ত যা-ই হোক না কেন, এখন পর্যন্ত এ আন্দোলন অনেকটাই সফল বলা যায়। সুন্দরবন বাঁচাও দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পুলিশি বাধার মুখে পড়ছে, সাদামাটা সাইকেল র্যালিতেও সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ হামলা চালাচ্ছে, পুলিশ জলকামান নিক্ষেপ করছে।
এমন অবস্থায় রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকার নির্মাণ করতে পারবে কি না, সেটা আপাতত পরের বিষয়, তবে এ মুহূর্তে রামপালবিরোধীদের সরকার ও সরকারি দল ভালো চোখে দেখছে না, বলা যায়। এমন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) রাতে আনসারুল্লাহর নামে সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলনের নেতা আনু মুহাম্মদকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এবং পরের দিন (বৃহস্পতিবার) তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলে ফের হত্যার হুমকি পান। আগের হুমকিতে হুমকিদাতা(রা) যেখানে নিজেদের আনসারুল্লাহ দাবি করেছিল; পরের স্ট্যাটাসে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, রামপালকে ‘হ্যাঁ’ বলুন, নইলে আমরা আপনাকে কুপিয়ে হত্যা করব! ('yes' to Rampal, otherwise you must will be hacked to death incredibly by us!) । সূত্র : আনু মুহাম্মদের ফেসবুক স্ট্যাটাস।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এক হুমকিতে আনসারুল্লাহর পরিচয় এবং অন্য হুমকিতে রামপালকে ‘হ্যাঁ’ বলার দাবি আসলে কে করল? প্রশ্নকারীদের বক্তব্য হতে পারে, আনসারুল্লাহ তো দেশে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সন্ত্রাসবাদে জড়াচ্ছে, তাদের তো রামপাল নিয়ে আগ্রহ থাকার কথা নয়। প্রশ্নগুলো অতি-অবশ্যই যৌক্তিক বলে জ্ঞান করি। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তর হচ্ছে, হতে পারে, আনসারুল্লাহ নাম উল্লেখ করে প্রথমে নিজেদের আড়াল করতে চেয়েছিল দুর্বৃত্তরা এবং পরে নিজেদের মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেছে রামপালকে ‘হ্যাঁ’ বলার নসিহত জানিয়ে। তা ছাড়া গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর জঙ্গিদের পরিচয় প্রদানকারী জঙ্গি পরিবার মানচিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। জঙ্গি রোহানের পিতার পরিচয় প্রকাশের পর এখন বলা যায় আনসারুল্লাহ, জেএমবি কিংবা আইএসের বাংলাদেশি সদস্যদের পারিবারিক পরিচয় যেকোনো জায়গা থেকেই হতে পারে।
আনু মুহাম্মদ এ মুহূর্তে সরকারের এক সিদ্ধান্তবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হওয়ার কারণে অনেকেরই চক্ষুশূল সন্দেহ নেই। সে ক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে, হত্যার হুমকি দিয়ে কিংবা সত্যি সত্যি অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটিয়ে এ আন্দোলনকে ধ্বংস করে দিতে অনেকেই হয়তো চাইবে। কিন্তু সেসব দুর্বৃত্ত কি জানে, শুধু আনু মুহাম্মদ কিংবা বামপন্থী দলগুলো অথবা জাতীয় কমিটির নাম দেখে কেউ সুন্দরবন বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করেনি? এটা এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাণের তাগিদে। তাই এভাবে আনু মুহাম্মদদের হুমকি দিলেও হয়তো কোনো লাভ হবে না, উল্টো হিতে বিপরীত হতে পারে!
হ্যাঁ, হয়তো সরকার তার সিদ্ধান্ত যেকোনোভাবে বাস্তবায়ন করে ফেলতে পারে; কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে ক্ষত সৃষ্টি হবে, সেটা উপশম করবে কীভাবে?
আনু মুহাম্মদকে হত্যার হুমকিদাতাদের পরিচয় প্রকাশ ও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের দায়িত্ব। আশা করি, ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত না হয়ে, কাউকে শত্রুজ্ঞান না করে সরকার তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে!
লেখক : প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম