জীবনের গল্পে জয়ী সুফিয়ার স্মৃতিকথা
জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে আমাদের জন্ম হয়নি। হাল না ছেড়ে, বেঁচে থাকার চেষ্টা করা দরকার। অভাব অনটনে শুধু চোখের জল না ঝরিয়ে উত্তরণের চেষ্টা থাকা দরকার। আমাদের ইচ্ছাশক্তিই পারে অভাবের গণ্ডি থেকে মুক্ত করে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখাতে। এমনটাই প্রমাণ করেছেন উপকূলীয় জেলা বরগুনায় বসবাসরত নারী সুফিয়া বেগম (৬০)। যিনি নিয়তিকে হার মানিয়েছেন কর্ম ও ইচ্ছাশক্তির কাছে।
এলাকার সবাই তাঁকে চেনেন ‘নূর-নাহারের মা’ নামে। তাঁর নাম সুফিয়া বেগম। গরিবের ঘরে জন্ম হয় সুফিয়ার। খুব অল্প বয়সেই তাঁর বিয়ে হয় আরেক গরিব রিকশাচালক আলী হোসেনের সঙ্গে। বিবাহিত জীবন শুরুর বছর দুয়েক পরেই তাদের সংসার আলোকিত করে জন্ম নেয় একটি মেয়ে সন্তান। তার বছর চারেক পরে জন্ম নেয় আরেক মেয়ে। এই দুই মেয়েই মারা যায়- খিঁচুনি ও ডায়রিয়া হয়ে। এরপরে জন্ম নেয় তৃতীয় মেয়ে নূর নাহার। আর নূর নাহারের বয়স যখন চার বছর, ঠিক তখন জন্ম হয় একটি ছেলে সন্তানের। এই দম্পতির সেই সন্তানটি জন্ম নেয় শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে। প্রতিবন্ধী সেই ছেলেটির নাম রাখা হয় শাহ জামাল।
স্বামী সংসার নিয়ে সুফিয়ার পরিবার চলতে থাকে। সুফিয়ার স্বামী আলী হোসেন মিয়া রিকশা চালাতেন। সেই উপার্জনে তাঁদের সংসার চলত। কথায় আছে, ‘মরার ওপর খরার ঘা’। হঠাৎ একটি দুর্ঘটনায় দীর্ঘদিনের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েন সুফিয়ার স্বামী। অভাবের ঘরে অভাব আরও চড়াও হতে থাকে। অসুস্থ স্বামী আর দুই সন্তানের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব আসে এই সুফিয়ার কাঁধে। সম্পূর্ণ পরিবারের ঘানি যখন সুফিয়ার কাঁধে ওঠে তখন তাঁর বয়স ৩০ বা ৩২ বছর হবে।
স্বামী সন্তানের মুখে একটু খাবার তুলে দিতে তাঁর জীবনে শুরু হয় যুদ্ধ। বেঁচে থাকার যুদ্ধ, বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ। সেই থেকেই এই নারীর জীবনে আর কর্মঘণ্টার গণ্ডি ছিল না। পরিবারের ক্ষুধা মেটাতে ছিল না নিজের ক্ষুধার চিন্তা।
পেটের তাগিদে গ্রামের বাড়ি রাজাপুর ছেড়ে চলে আসে বরগুনায়। অসুস্থ স্বামী-সন্তান নিয়ে বরগুনার একটি সড়কের পাশের সরকারি খাস জমিতে এক ঝুপড়ি ঘরে কাটতে থাকে সুফিয়া ও তাঁর পরিবারের অনাহার-অর্ধাহারের দিন-রাত্রি। তখন নারীর পরিশ্রমের যথাযথ দাম ছিল না। সুফিয়া সারা দিন খেটেও তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারতেন না পরিবারের জন্য। প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে তাঁকে। ভাতের আশায় প্রতিদিন একাধিক ঘরে ঝিয়ের কাজ করেছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি খেটে কংকালসার হয়ে যান সুফিয়া। তবু জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে করতেন কঠোর পরিশ্রম।
বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ, মাটি কাটার কাজ, মাটির চুলা তৈরির কাজ, অন্যের বাড়ি-ঘর পরিষ্কার-পরিছন্ন করে দেওয়ার কাজ, ধান সেদ্ধ করার কাজ, গবাদি পশু দেখভালের কাজ। হেন পরিশ্রমের কাজ করে জুগিয়েছেন স্বামী সন্তানের আহার।
মানবেতর জীবনের সেই দৃশ্য চোখ কাড়ে তৎকালীন সেই এলাকার কিছু গণ্যমান্যদের। তাদের সহায়তায় চার সদস্যের পরিবার নিয়ে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয় বরগুনার কড়ইতলা সুজার খেয়াঘাট আশ্রয়ণ প্রকল্পে। এখানেই মাথা গোঁজার স্থায়ী বন্দোবস্ত হয় সুফিয়া পরিবারের। সেই থেকে বসত বরগুনাতে।
সুফিয়ার জীবন যুদ্ধ খুব কাছ থেকে দেখেছেন, বরগুনা সরকারি শিশু পরিবারের শিক্ষিকা সেলিনা পারভিন। এক সময় সুফিয়া কাজ করতেন এই শিক্ষিকার ঘরে। তিনি বলেন, মানুষ যে পরিবারের প্রয়োজনে কতটা পরিশ্রম করতে পারে তার প্রমাণ ‘সুফিয়া’। কোনো ঘরে কাজের বিনিময়ে একটু ভাত- তরকারি দিলেও তা নিজে না খেয়ে নিয়ে যেতেন স্বামী-সন্তানের জন্য। এত কষ্ট করে, তিনি টিকিয়ে রেখেছেন তাঁর সংসার।
সে সময়কার স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে সুফিয়া জানালেন, তখন এমনিতেই কাজ পাওয়া যেত না। তার ওপরে, চলাচলে অক্ষম ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কাজে গেলে কেউ কাজে রাখতে চাইত না। ফলে ছেলেটাকে বাসায় রেখে যেতে হতো। আর এ কারণে মেয়েটাকেও লেখাপড়া করাতে পারিনি।
সুফিয়ার মেয়ে নূর নাহারের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এই ঘরের সদস্য সংখ্যা কমে যায়। চার সদস্যের এই পরিবারে এখন রয়েছে তিনজন। অসুস্থতার কারণে সুফিয়ার স্বামী কোনো ভারি কাজ করতে পারেন না। কাজে অক্ষম হলেও সুফিয়ার স্বামী মাঝেমধ্যে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। এই ঝালমুড়ির আসল কারিগর সুফিয়া। সকালে কাজে যাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় সব কিছুর বন্দোবস্ত করে দিয়ে যান তিনি।
সুফিয়া বলেন, ‘এখন তো ভালোই আছি, মাঝেমধ্যে মনে পড়ে পরিবারের অভাবের দিন শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত ২০ বছরের মধ্যে দিনে বা বিকেলে কখনোই একটু বিছানায় বসতেও পারি নাই। শরীরে জ্বর নিয়েও কাজ করেছি।’
চোখ মুছতে মুছতে সুফিয়া জানান, তাঁর জীবনের কথাগুলো। আগের মতো চোখে দেখতে পান না তিনি। বয়সের কারণে কোমর ও পিঠে ব্যথা বাসা বেঁধেছে। কয়েক বছর আগেও (মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আগ অবধি) খুব হতাশার মধ্যে দিন কাটত তাঁর। চলাচলে অক্ষম ছেলেটাও এখন বড় হয়েছে, হুইল চেয়ার নিয়ে নিজেই ঘুরে আসতে পারেন পুরোটা গ্রাম। তাই মায়ের দুশ্চিন্তাও একটু কমেছে। তবু ফেলে আসা সেসব দুর্দিনের স্মৃতি আজও ঠিকমতো ঘুমাতে দেয় না সুফিয়াকে।
জীবনের শুরু থেকেই কষ্ট করতে করতে আজ কষ্টকেই সুখের হাতিয়ার বানিয়েছেন সুফিয়া। আজও দমে যাননি এই নারী। আজও তিনি কাজ করেন একটি পুরাতন প্লাস্টিক কাটার কারখানার। নিজের ইচ্ছাশক্তির জোড়ে সুফিয়া আজও বলেন, ‘মৃত্যুর আগ অবধি কাজ করতে প্রস্তুত আছি।’
সুফিয়া বেঁচে আছেন। হয়তো প্রতিদিন এ সমাজকে শিক্ষা দিতেই তিনি আজও বেঁচে আছেন। সুফিয়া এ সমাজকে শিক্ষা দিয়ে চলেছেন, ‘কর্মময় নারীরা শুধুই মা নয়, তাঁরা প্রত্যেকেই একজন যোদ্ধা।’