নির্বাচন
জেলা পরিষদ নির্বাচন-পরবর্তী পর্যালোচনা
দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর বর্তমান সরকার স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠান হিসেবে জেলা পরিষদ পুনর্গঠনে উদ্যোগী হয়েছে। এখন জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকই সর্বেসর্বা। রাজনীতিক ও আমলাদের টানাপড়েনে সবচেয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে জেলা প্রশাসন। ১৯৭৫ সালে জেলা প্রশাসন থেকে আমলাদের হটিয়ে রাজনীতিকদের ক্ষমতায়ন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তৎকালীন ৬৪টি জেলায় গভর্নর নিয়োগ করা হয়।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এ পদ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের পটপরিবর্তনের সময়ে জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ চলছিল। সামরিক শাসন আমলে জেলা প্রশাসনে রাজনীতিকদের নিয়োগ লক্ষ করা যায়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এঁদের বলা হতো ‘ডিস্ট্রিক্ট কোঅর্ডিনেটর’ বা জেলা সমন্বয়কারী। এরশাদ আমলেও অনুরূপ নামে তাঁদের ডাকা হয়। সামরিক প্রশাসনে জেলা পর্যায়ের নেতৃত্ব বিকশিত হয়নি; বরং এঁরা জেলা প্রশাসকের প্রাধান্য মেনে নিয়েই জেলার রাজনৈতিক সমন্বয়ের কাজ করেন।
আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ ও ২০০৯ আমলে জেলা পরিষদ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। তবে ২০১১ সালে তারা জেলা পরিষদের প্রধান হিসেবে তাঁদের জেলাভিত্তিক নেতাদের নিয়োগ করে। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে তথা দলীয় মনোনয়নে প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। যে কৌশলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, প্রতিটি স্তরে সে একই কৌশলের অনুকরণ-অনুসরণ পরিলক্ষিত হয়।
২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জেলা পরিষদ নির্বাচন। এ নির্বাচনটি ছিল পরোক্ষ। সংবিধানে প্রত্যক্ষ ভোটের বাধ্যবাধকতা থাকলেও জেলা পরিষদ নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের অধিকার অস্বীকার করা হয়। এখানে ভোটার হলো নির্বাচিত সব প্রতিনিধি। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের সব সদস্য এবং জেলার অন্তর্ভুক্ত সব পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত সব সদস্য জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার। ষাটের দশকে আইয়ুব খান প্রবর্তিত মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বসাধারণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছিল ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার-চেয়ারম্যানদের। ওই ব্যবস্থায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ হাজার করে সমসংখ্যক সদস্য ভোটদানে অংশগ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, জাতীয় পরিষদ নির্বাচন ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে এরাই ছিল একমাত্র ভোটার।
নিরুত্তাপ-নিরানন্দ জেলা পরিষদ নির্বাচনের সম্পূর্ণ ফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় সব জেলা পরিষদে এরই মধ্যে সরকারি দলের জয়জয়কার ঘোষিত হয়েছে। সর্বশেষ ফলাফলে জানা যায়, তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি বাদে ৬১ জেলায় ভোট গ্রহণ হয়েছে। এর মধ্যে ২১ জেলায় চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী থাকায় তাঁরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে আছেন। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী। এ ছাড়া কুষ্টিয়া ও বগুড়ায় চেয়ারম্যান পদে ভোট স্থগিত করা হয়।
জাতীয় সংসদে তথাকথিত বিরোধীদল জাতীয় পার্টির প্রাধান্যশীল জেলাগুলোতে অংশগ্রহণ করে। ১৪ দলীয় জোটভুক্ত অন্য ছোট ছোট দলের প্রার্থীরাও অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের জয়লাভের কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড সর্বাত্মক চেষ্টা করেও তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে রাখতে পারেনি। জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটারদের সংখ্যা সীমিত হওয়ায় নব্য ধনিক শ্রেণি অর্থের বিনিময়ে ভোটে জেতার চেষ্টা করে। গণমাধ্যমে অর্থের ব্যাপক ছড়াছড়ির অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। জনগণের ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় ভোটের দিন তেমন সন্ত্রাস সহিংসতা হয়নি। তবে পরোক্ষ ভোটাররা ভয়ভীতি ও সন্ত্রাস-সংহিসতার শিকার হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রায় সব জেলায় অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন মোতায়েন করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি ঘোষণা করলেও সরকারি দলের লোকেরা তা তোয়াক্কা করেননি। এমপিরা নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় সংসদের স্পিকারের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে নির্বাচনকালীন নিজ নিজ জেলায় অবস্থান করেছেন। প্রার্থীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এমপিরা পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছেন। কেউ কেউ ভোটের বিনিময়ে টিআর-কাবিখা বরাদ্দের কথাও বলেছেন। এসবই নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লক্ষণ। নির্বাচন কমিশন এসব অভিযোগ জানা সত্ত্বেও তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। উল্লেখ্য, জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধিনে সর্বশেষ নির্বাচন।
স্থানীয় সরকার সম্পর্কে তোফায়েল আহমেদ মন্তব্য করেন, এক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচনের সার্থকতা প্রমাণ করে না; বরং প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি অর্থবহ হতে পারত। এ ধরনের একক প্রদর্শনী সন্ত্রাস-সহিংসতা এবং কালো টাকার প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে। পত্রিকান্তরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মন্তব্য করেন যে, ক্ষমতা এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আজ অর্থবিত্ত তৈরির মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এ জন্যই কিছু রাজনৈতিক নির্বাচনে অর্থ বিনিয়োগ করে। নির্বাচিত হওয়ার জন্য দুর্বিনীত হয়ে ওঠে। তার নির্বাচিত হওয়া অর্থবিত্তের দুয়ার, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির পথ খুলে দেবে।
লেখক : অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।