অভিমত
হিরো, হিরোইজম এবং হিরো আলম

বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে ‘হিরো’ বা ‘হিরোইন’ হওয়া আজকাল খুবই সহজ যদি আপনার তিনটি জিনিস থাকে : প্রচুর টাকা, জ্ঞাতি সম্পর্ক এবং আপেল-আপেল চেহারা। এক. যদি প্রচুর টাকা থাকে তবে আপনি প্রযোজক হিসেবে টাকা লগ্নি করবেন এবং নিজেই নিজের ছবির হিরো বা হিরোইন হয়ে যাবেন। এ রকম অসংখ্য নজির বাংলাদেশে আছে। দুই. আপনার যদি মা, বাবা, শ্বশুর, শাশুড়ি বা ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন কেউ একজন সিনেমায় কাজ করেন এবং বিনোদন-ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত তাহলে আপনি আপনার এ জ্ঞাতি সম্পর্কের গুণেই হিরো-হিরোইন হয়ে যেতে পারেন। এবং বাবা-মায়ের বা জ্ঞাতি সম্পর্কের ইমেজকে পুঁজি করে আপনি দ্রুত হিরো বা হিরোইন হয়ে যেতে পারেন। তিন. এটি অত্যন্ত বর্ণবাদি দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু বাস্তবতা এ রকমই। আপনার যদি একটা ফর্সা, সুন্দর, স্লিম, আকর্ষণীয় চেহারা থাকে আর জায়গা মতো খাতির থাকে, তবে আপনি সহজেই হিরো বা হিরোইন হয়ে যেতে পারেন। বাংলাদেশের মতো দেশে হিরো বা হিরোইন হওয়ার এগুলো মোটামুটি প্রাথমিক যোগ্যতা। অভিনয় আপনি কেমন করেন বা আদৌ করতে পারেন কি না, সেটা একেবারেই বিবেচ্য বিষয় নয়। সত্যিকার অর্থে হিরো বা হিরোইন হওয়ার জন্য এখন যেটা একেবারইে লাগে না, সেটা হচ্ছে অভিনয় করার সক্ষমতা! অভিনয় ছাড়াও আপনার যদি উল্লেখিত তিনটি কোয়ালিটি থাকে, তাহলেই আপনি হিরো বা হিরোইন হতে পারেন। কিন্তু যার এ তিনটার কোনোটাই নাই, তার পক্ষে হিরো হওয়া খুবই কঠিন। অথচ এ কঠিন কাজটিই সহজ করে আমাদের প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে একজন আজ হিরো। এ রিয়েল হিরো যার নাম ‘হিরো আলম’।
সম্প্রতি হিরো আলম আবার ‘হিরো’ হয়ে উঠেছেন মিডিয়ার কল্যাণে। বলিউডের সুপার স্টার সালমান খানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, এবং সালমান খানকে টেক্কা দিয়ে হিরো আলম একটা বিশেষ ক্যাটেগরিতে নতুন করে হিরো হয়ে উঠে নতুন সেনসেশনের জন্ম দিয়েছেন। ইন্টারনেটে ‘খোঁজ’ করার সংখ্যা-বিবেচনায় ‘হিরো আলম সালমান খানকে ছাড়িয়ে গেছে’--এটা বেশ কয়েকদিন ধরে একটা ‘গরম’ খবর। এ খবরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এবং ভারতে একটা আলোচনা বেশ জমে উঠেছে। আল্টিমেট ইন্ডিয়ার বরাত দিয়ে ইউএনবির খবরে বলা হয়েছে, গুগলে কাকে সবচেয়ে বেশিবার খোঁজা হয়, তার একটি তালিকা করে ইয়াহু ইন্ডিয়া। এ বছরও তারা সেই তালিকা করতে জরিপ চালিয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, দাবাং এবং সুলতানের তারকা ভারতসহ গোটা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় হিরো সালমান খানকে পেছনে ফেলেছেন বাংলাদেশের হিরো আলম। কারণ ইয়াহু ইন্ডিয়ার খবর অনুযায়ী এ বছর সালমানের চেয়েও বেশিবার খোঁজা হয়েছে হিরো আলমকে। এতেই হিরো আলম নতুন করে আলোচনায় আসেন এবং নিজের হিরোইজমের নতুন ইমেইজ নবায়ন করেন। আল্টিমেট ইন্ডিয়ার খবরে আরো বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয় বাংলাদেশের হিরো আলম। ইউটিউবে প্রকাশ করা তাঁর নিজস্ব ভিডিও গুলোও অনেক জনপ্রিয়। ভিডিও গুলোর নির্দেশনা দেন খোদ হিরো আলম। ভিডিওগুলোর মূল চরিত্রে তিনি নিজেই অভিনয় করেন। মানুষ তাঁকে নিয়ে সমালোচনা ও হাসাহাসিও করেন। এই হাসাহাসি বা সমালোচনাই তাঁকে বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে। তাঁর জনপ্রিয়তা এমন এক পর্যায়ে গেছে যে, মূল ধারার মিডিয়া তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্টোরি করেছে, বিভিন্ন প্রাইভেট চ্যানেলে তাঁকে নিয়ে আলোচন হয়েছে, টক শো হয়েছে, লাইভ শো হয়েছে। তিনি প্রফেশনাল বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেছেন তাঁর এ জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে।
এখানে মনে রাখা জরুরি যে, হিরো আলম বিজ্ঞাপন করে জনপ্রিয় হননি বরঞ্চ তাঁর জনপ্রিয়তার জন্যই তাকে বিজ্ঞাপনে কাস্ট করা হয়েছে। তবে, হিরো আলমের এ কৃতিত্ব নিয়ে নানান কিসিমে ‘মশকরা’ও হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। বাংলাদেশে অনেকেই জনপ্রিয়তায় সালমান খানকে টপকানোর বিষয়টা নিয়ে বেশ ‘মজা’ নিচ্ছেন। আর ভারতে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিরো আলমের ভিডিও ফুটেজকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিকে হেয় প্রতিপন্ন করার একটা প্রচেষ্টাও চলছে তলে তলে। কোন কোন ক্ষেত্রে সেটা বেশ সচেতনভাবেও করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশে তো হিরো আলম শুরু থেকেই ‘হাসির পাত্র’। অনেকের কাছে হিরো আলম হয়ে উঠেন ‘ফান আনলিমিটেড’!
কিন্তু আমি হিরো আলমের এ উত্থান, তার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা, ইন্টারনেটে খোঁজ করার ক্ষেত্রে সালমান খানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার রেকর্ড, তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি ও মশকরা এবং ভার্চুয়াল জগতে তাঁর হিরোয়িক উপস্থিতিকে হিরো, হিরোইজম এবং হিরো-ইমেজ সম্পর্কিত সমাজে বিদ্যমান ডিসকোর্সকে নতুন করে বিনির্মাণ করার একটা চমৎকার সম্ভাবনা হিসেবে দেখতে পাই। কেননা হিরো আলমের কেসটি বাংলাদেশে হিরো, হিরোইজম এবং হিরো-ইমেজ সম্পর্কিত যে বর্ণবাদি ডিসকোর্স সমাজে জারি আছে তাকে বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সমাজের উঁচুতলার মানুষের মৌসুমি মনোরঞ্জন এবং শহুরে-শিক্ষিত-নাগরিক-মধ্যবিত্তের আয়েশী রুচির আজ্ঞাবহ হয়ে বেড়ে উঠা ‘হিরো’ সম্পর্কিত বিদ্যমান ডিসকোর্স হিরো আলমের হিরো হয়ে উঠার ভেতর দিয়ে সত্যিকার অর্থেই বিনির্মিত হয়। এ নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে পোষণ করছি। তবে, আমার চিন্তা-ভাবনার একটা সার-সংক্ষেপ পেশ করছি।
এটা অনস্বীকার্য যে, বলিউড সুপার স্টার ‘ইন্টারনেটে খোঁজ’ করার সংখ্যা বিবেচনায় সালমান খানকে টেক্কা দিয়ে হিরো আলমের নতুন করে হিরো হয়ে উঠা নিয়ে অনেকেই আসলে বেশ ‘মজা’ নিচ্ছেন। কারণ আমাদের এলিট মনোজগত ‘হিরো আলম সালমান খানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে’ এধরের ঘটনা এবং সংবাদকে ঠিক মেনে নিতে চায় না। আমাদের দীর্ঘদিনের সচেতন অনুশীলনের ফলে গড়ে উঠা এক ধরনের এলিট খুঁতখুঁতানি হচ্ছে, হিরো আলমের ‘চেহারা’, ‘বডি’, ‘সামাজিক অবস্থান’ এবং ‘শ্রেণি’ সালমান খানের মতো নয়; হিরো আলম ‘বলিউডের’ তো নয়ই, ‘ঢালিউডের’ও কেউকেটা কেউ নন; সে ‘হিরো আলাম’ বলিউড সুপারস্টার সালমান খানকে খোঁজ-জনপ্রিয়তায় (সার্চ-পপুলারিটি) টপকে যান, এটা একটা বিরাট ‘ফান’। কিন্তু আমরা এভাবে কখনো দেখি না যে, হিরো আলম আমাদের এন্তার বিনোদন-ইন্ডাস্ট্রিকে চ্যালেঞ্জ করেই আজ ‘হিরো’।
একজন ক্যাবল অপারটের ব্যবসায়ী এবং অতি সাধারণ একজন মানুষ যিনি সমাজের নীচতলার মানুষদের কাতারে বসবাস করেন। তার গোলাপি গাল নাই, নাদুস-নুদুস চেহারা নাই, ফোর-প্যাক বা সিক্স-প্যাক বড়ি নাই, জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ সিনেমায় অভিনয়ের স্বপ্নই দেখেন নাই, বাস্তবে নায়ক হওয়া তো দূরের কথা এবং যার কোনো অর্থের প্রাচুর্য নাই যে নিজে প্রযোজক হয়ে নিজেই নায়ক হয়ে যাবেন। এতসব ‘নাই’ নিয়েই হিরো আলম ‘আছেন’। আছেন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়, আছেন টিভির বিজ্ঞাপনে, আছেন ইউটিউবে এবং ইউটিউব চ্যানেলে এবং আছেন ইন্টারনেটের খোঁজাখোঁজির রেকর্ডের তালিকায়। এটা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের নাক-উঁচা আপার-ক্লাস এবং নিত্য-ভাব নিয়ে চলা মিডল ক্লাসের দর্শন দিয়ে গড়ে উঠা ‘স্টারইজম’কে চ্যালেঞ্জ করেই সমাজের নিম্নবর্গের এবং নিচতলার মানুষের হিরো এ ‘হিরো আলাম’। ‘চেহারা’, ‘বডি’, ‘জ্ঞাতিসম্পর্ক’, ‘আর্থিক অবস্থা’, এবং ‘সামাজিক অবস্থান’ ইত্যাকার উপাদান যখন বিনোদন-ইন্ডাস্ট্রিতে হিরো হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা, সেখানে সব ধরনের ‘অযোগ্যতা’ নিয়েই নিজের যোগ্যতায় হিরো আলম আজ ‘হিরো’। তাই এ হিরো আলমই রিয়েল ‘হিরো’। সালমান খান তো নস্যি, সামনে আরো কত ‘খান’ খান খান হয়ে যাবে সেটাই দেখার বিষয়! সেদিনের অপেক্ষায়...!
লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।