একুশে বইমেলা
শিশুদের মতো প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের বিশেষ সুযোগ প্রয়োজন
এক সময় সমাজে প্রতিবন্ধিতা একধরনের অভিশাপ হিসেবে বিরাজমান মনে করলেও এখন দিন পাল্টেছে। সেই সঙ্গে পাল্টেছে ধারণাও। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়ায় এখন প্রতিবন্ধিতা অভিশাপের পরিবর্তে আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করলে খুব একটা ভুল হবে না। কারণ দেশের মানুষ এখন আগের তুলনায় এসব বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন। দেশের সরকার এবং বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছে। সেজন্য প্রতিবন্ধীরা ভালোভাবে জীবন-যাপন তো করছেই, সেইসঙ্গে তাদের এখন শিক্ষাগ্রহণ করে উচ্চশিক্ষিত হওয়ারও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ১৬ মিলিয়ন লোক কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ১০ ভাগ। ২০০৪ সালের এক পরিসংখ্যান হতে জানা যায়, মোট প্রতিবন্ধীর মধ্যে ৬% হলো ১৮ বছরের নিচে এবং ১৪% প্রতিবন্ধী হলো ১৮ বছরের উপরে।
প্রতিবন্ধিতার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। তারমধ্যে কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধী, কেউ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, কেউ মুক বা বধির, আবার কেউবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। কিন্তু যেভাবেই প্রতিবন্ধী হোন না কেন তারা কোনো অনুকম্পা চায় না। তারা চায় একটু সম্মান ও সহযোগিতা। তবে সব ধরনের প্রতিবন্ধিতার মধ্যে অন্ধত্ব সবচেয়ে বেশি নিদারুণ ও করুণ। কীভাবে একজন মানুষ অন্ধত্বের শিকার হয়? কেউ থাকে জন্মান্ধ আবার কেউ জন্মের পর বিভিন্ন রোগের কারণে স্থায়ী অন্ধত্বে রূপান্তরিত হয়।
এখন বাংলাদেশে স্থায়ী অন্ধ লোকের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে অন্ধ লোকের এ সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। অথচ একটু সচেতন হলেই ভয়াবহ এ রোগ থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। ফিরে পেতে পারে মহা মূল্যবান চোখের দৃষ্টি। অন্ধত্ব নিয়েও আজকে অনেক লোক কারোর করুণায় নয়, বরং তাদের নিজস্ব যোগ্যতায় বিশেষ পদ্ধতিতে স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে জীবন গঠনের জন্য চাকুরি করে নিজের এবং পরিবারের হাল ধরছে। সরকারি ও বেসরকারি অনেক চাকরিতেও কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে তাদের জন্য।
এখন ঢাকায় একুশে বইমেলা চলমান। অনেক আগে থেকেই বাংলা একাডেমি কর্তৃক অনানুষ্ঠানিক বইমেলা আরম্ভ হলেও রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় তা শুরু হয়েছে ১৯৮৪ সাল থেকে। প্রথমে বাংলা একাডেমির নিজস্ব চত্বরে আয়োজন করা হলেও এখন দিনে দিনে এ মেলা বাঙালির আবহমান ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় এর কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেজন্য কয়েক বছর ধরে তা সম্প্রসারিত করে বাংলা একাডেমির চত্বরের গণ্ডি ছাড়িয়ে পাশের বিশাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এখন সেখানে মাসাবধি চলা এ মেলায় প্রতিদিন সারাদিন সব পর্যায়ের মানুষের ঢল নামে।
সেই মানুষের ঢলের মধ্যে দেখা গেছে গত দুই বছর থেকে মেলায় শিশুদের মধ্যে বইয়ের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বইমেলায় তাদের জন্য নির্ধারিত দিন ও সময় ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে শুক্র ও শনিবার সকাল ১১ ঘটিকা থেকে বেলা ১ ঘটিকা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা সময় শিশুদের জন্য মেলায় নির্ধারিত রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয় শিশুদের কথা মাথায় রেখে তাদের জন্য আলাদা কর্নার ও স্টল স্থাপন করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে এ সুযোগে যেখানে অভিভাবকরা বইমেলায় ভিড়ের চাপে সমস্যার কথা চিন্তা করে যেসব শিশুকে বইমেলায় নিয়ে আসার সাহস পেতেন না, এখন সময় ও সুযোগ হাতের নাগালের মধ্যে থাকায় সেখানে নির্ধারিত দিন ও সময়ে সেখানে বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুদের ঢল নামছে, যা মেলাকে প্রাণবন্ত করছে।
কিন্তু একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা দরকার, বইমেলায় শিশুদের মতোই বৃদ্ধ কিংবা প্রতিবন্ধীদের জন্য এমন নির্ধারিত দিন ও সময় আলাদা করে দেওয়া যেতে পারে। অনেক প্রবীণ পাঠক রয়েছেন যাঁরা প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মেলায় অস্বাভাবিক ভিড়ের কথা চিন্তা করে মেলায় আসার কথা চিন্তা করেন না। সেখানে শারীরিক মানসিক, দৃষ্টিসহ অন্যান্য সব পর্যায়ের প্রতিবন্ধীদের জন্যও শিশুদের মতো করে আলাদা সময়, সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যদি বন্ধের দিন সকাল ১১ ঘটিকা থেকে বেলা ১ ঘটিকা পর্যন্ত সময় দেওয়া শিশুদের জন্য, সেখানে মাঝখানে একঘণ্টা সময় বিরতি দিয়ে উক্ত দুদিন বেলা ২ ঘটিকা থেকে বিকাল ৫ ঘটিকা পর্যন্ত সময় তাদের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। তাতে ৫ ঘটিকার পর সর্বসাধারণ সেখানে গিয়ে তাদের কার্যক্রাম সেরে নিতে পারে।
তাদের মেলায় অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করার জন্য সেখানে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা প্রয়োজনে বৃদ্ধি করে ঢোকার গেটগুলো থেকে প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের পরিবহনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। শাহবাগ মোড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এবং শিশু পার্কের সামনে থেকে তাদের আনা-নেওয়া করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া গেলে চলমান বইমেলা আরো অর্থবহ, প্রাণবন্ত ও সফল হতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারণ মেলায় গমণাগমন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। কাজেই এ নিরাপদ মেলার স্বাদ সব বাঙালির পাওয়া উচিত।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়