সাদাসিধে কথা
আহা চিকুনগুনিয়া

ঈদের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মেঝেতে পা দিয়ে আমি চমকে উঠেছি, পায়ের তলায় প্রচণ্ড ব্যথা! গতরাতে আমি ঠিক কোথায় কীভাবে হাঁটাহাঁটি করেছি যে পায়ের নিচে এত ব্যথা, সেটা যখন চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করছি, তখন আমার স্ত্রী আমাকে মনে করিয়ে দিল, বলল, ‘এটা সম্ভবত চিকুনগুনিয়া।’
সে এই ভয়াবহ রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে তিন দিন থেকে কাবু হয়ে আছে!
বেশ কিছুদিন থেকে আমি খুব জরুরি কাজে ব্যস্ত দিনের পর দিন টানা কাজ করেও কুলিয়ে উঠতে পারছি না। আমার স্ত্রীর ভবিষ্যদ্বাণী শুনে আমি বুঝতে পারলাম, এখন দেখতে দেখতে জ্বর উঠে যাবে এবং আমি সম্ভবত দীর্ঘদিনের জন্যে অচল হয়ে যাব। আমি তাই জ্বর উঠে যাওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে যেটুকু সম্ভব অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে বিছানায় কাত হয়ে পড়লাম এবং ঢাকা শহরের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আমাকে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত করল!
অসুখ-বিসুখ খুবই ব্যক্তিগত বিষয়, এটা নিয়ে গল্প করার কিছু নেই। নিজের অসুখ নিজের কাছেই গোপন রাখতে হয়। কিন্তু আমার মনে হয়, চিকুনগুনিয়া নামের এই অসুখ নিয়ে একটু কথাবার্তা বলা উচিত। আমি যেটুকু জানি, এটি এখন আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেই। ঢাকা শহরের যে মানুষের সঙ্গেই কথা বলছি তাঁরা সবাই বলছেন, এটা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। ঠিক কতজন মানুষ আক্রান্ত হলে একটা অসুখকে ‘মহামারি’ বলা যায়, আমি জানি না; কিন্তু এটি যে ব্যাপক আকারে ঢাকা শহরের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে, তার মাঝে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
এই রোগটিতে দেখতে দেখতে তাপমাত্রা বেড়ে যায়, তার সঙ্গে শরীর প্রচণ্ড ব্যথা ছোট থাকতে যে ‘হাড় সুড়সুড়ি’ ব্যারামের গল্প শুনেছিলাম, সেটি নিশ্চয়ই এই অসুখ।
প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেয়ে শরীরের প্রচণ্ড ব্যথা এবং জ্বর কমানোর চেষ্টা করতে হয় এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ ওষুধ খেয়েও যখন জ্বর নামানো যায় না, তখন জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা চলে আসে। অনেক ভোগান্তির পর জ্বর যখন কমে আসে তখন দেখা যায়, মুখে রুচি বলতে কিছু নেই। খেতে হবে সে কারণে জোর করে কিছু খেয়েও লাভ নেই, হড় হড় করে বমি হিসেবে বের হয়ে আসে। ডাক্তার বারবার করে বলে দিয়েছে শরীরের ওপর চাপ না দিতে; তাদের কথা যথোপযুক্ত গুরুত্ব না দেওয়ার ফলটা আমি হাতে হাতে পেয়েছি। যখন মোটামুটি ঠিক হয়ে যাচ্ছি বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে ঘর থেকে একটুখানি বের হওয়ার চেষ্টা করেছি, তখন পুরো রোগটা আবার গোড়া থেকে শুরু হয়ে গেল, আবার জ্বর, আবার শরীরে ব্যথা, আবার বমি, আবার খাবারে অরুচি, আবার জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা!
আমার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে যে আমি আমার একেবারে ব্যক্তিগত অসুখের বর্ণনাটি এভাবে দিচ্ছি। কিন্তু এটি মোটেও আমার একার বর্ণনা নয়, ঢাকা শহরের অসংখ্য মানুষ এ মুহূর্তে এই রোগে ভুগছে। জ্বরজারি হয়, এক-দুদিন ভুগে মানুষ ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু এটা মোটেও সে রকম কিছু নয়। যাঁরা অনেক কষ্টে সুস্থ হয়েছেন, তাঁরা সবাই বলেছেন, এই রোগটি থেকে আরোগ্য হতে বহুদিন বহু সপ্তাহ লেগে যায়।
যাই হোক, ঢাকা শহরের বাসিন্দার জন্য এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় বিপর্যয়। মহামারি থামানোর নিশ্চয়ই নিয়ম আছে। আমি আশা করে আছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও করপোরেশন মিলে এই যন্ত্রণার মূলোৎপাটন করবে।
ডেঙ্গুর মতো চিকুনগুনিয়া আসে মশার কামড় থেকে, যেহেতু এদের কোনো প্রতিষেধক নেই, টিকা নেই, তাই এর থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় একটাই, মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। মশাকে যদি দূর করে দেওয়া যায়, তাহলে মশার কামড়ও দূর হয়ে যাবে, তাই ঘুরেফিরে কাজ একটিই, সেটি হচ্ছে মশা নিয়ন্ত্রণ।
মশা নিয়ন্ত্রেণের কথা বললেই সবার চোখের সামনে মশার কয়েল এবং মশার স্প্রের কথা ভেসে ওঠে। কোনো মশার কয়েল কিংবা কোনো মশার স্প্রে দিয়ে কোনো মশাকে কতটুকু নিধন করা যায় আমার কোনো ধারণা নেই। শুধু কমনসেন্স দিয়ে অনুমান করতে পারি এগুলো বিষাক্ত কেমিক্যাল, তাই সরাসরি মশাকে মারতে পারুক আর না-ই পারুক, আমাদের শরীরের যে বারোটা বাজিয়ে দেয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের দেশে যেহেতু কোনো কিছু নিয়েই কোনো ধরনের নিয়ম নেই, আমরা ভেজালের মাঝে থাকি, বিষাক্ত খাবার খাই, দূষিত পরিবেশে বড় হই, তাই এ মুহূর্তে একটু আরাম পেলেই খুশি ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা করি না। কিন্তু কোথাও না কোথাও এখন এইসব নিয়ে নিয়মনীতি করার সময় এসেছে।
চিকুনগুনিয়া রোগটি ছড়ায় এডিস মশা, এরা একটুখানি পানি এবং এক সপ্তাহ সময় পেলেই বংশবৃদ্ধি করে ফেলে। আমাদের ঢাকা শহরে পানির অভাব নেই, সেই পানিকে এখানে সেখানে জমতে দিলেই সমস্যা। আমরা চোখ খুলে তাকালেই দেখব এখানে সেখানে প্লাস্টিকের বোতল, ভাঙা জিনিসপত্র, পুরোনো টায়ার, ফুলের টব, মাটিতে গর্ত কাজেই মশাগুলো মহানন্দে বংশবৃদ্ধি করে এবং সেই মশার সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার রোগীর সংখ্যা বাড়ে এবং কমে।
কাজেই আমাদের কমনসেন্স বলে সবার আগে মশার বংশবৃদ্ধির এই পথটুকু বন্ধ করতে হবে। সবাই যদি নিজের বাসায়, বাসার চারপাশে মশার বংশবৃদ্ধির পথটুকু বন্ধ করে রাখে, তাহলে অনেক বড় একটা কাজ হবে।
মনে আছে যখন প্রথম পত্রিকায় ‘চিকুনগুনিয়া’ নামটি দেখেছি, তখন শব্দটির বিচিত্র বাচনভঙ্গি নিয়ে আমি তামাশা করেছি। এখন অবশ্যি জানি এটি তামাশার শব্দ নয়, কেউ এটি নিয়ে আর তামাশা করে না। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে এবং শুনেছি এটি এখন টেলিভিশনের টক শোর একটি জনপ্রিয় বিষয়।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে এটাকে খাটো করে দেখানোর আন্তরিক চেষ্টা করে যাওয়া হচ্ছে, সেটা সবাই লক্ষ করেছে। আমি কর্মকর্তাদের বলতে শুনছি, এটি মোটেও মহামারি নয়, ঢাকার বাইরে একজনেরও এই অসুখ হয়নি, এই অসুখে কেউ মারা যায়নি ইত্যাদি ইত্যাদি।
মহামারির সংজ্ঞা কী আমি জানি না, অসুখটি শুধু ঢাকা শহরের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে না কিংবা যেহেতু কেউ মারা যাচ্ছে না, তাই আমরা এটাকে উড়িয়ে দেব কি না, আমি তার উত্তর জানি না। তবে যারা এই রোগে ভুগেছে, তারা এর যন্ত্রণাটুকু একেবারে আক্ষরিকভাবে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। আমি অসুস্থতার বাহানা করে বিছানায় শুয়ে বসে আহা-উঁহু করে পরিচিত মানুষের সমবেদনা পেতে পারি। কিন্তু যারা খেটে খাওয়া মানুষ, তারা কী করবে? একজন শ্রমিক, গার্মেন্টসের মেয়ে, রিকশাওয়ালার যখন চিকুনগুনিয়া হবে, তাদের রুটিরুজি কি বন্ধ হয়ে যাবে না?
একজন রেগেমেগে ক্ষতিপূরণ দাবি করে হাইকোর্টে রিট করে দিয়েছেন। আমি এই মানুষটির ক্ষোভ পুরোপুরি বুঝতে পারি। যদি সিটি করপোরেশন কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একেবারে জান দিয়ে চেষ্টা করেও এটাকে সামলাতে না পারত, তাহলে মানুষেরা মেনে নিত। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণের একেবারে কিছুই করা হয়নি—সবার ভেতরে এ রকম একটা ধারণা হয়ে গেছে এবং ক্ষোভটা এই কারণে অনেক বেশি।
যাদের চিকুনগুনিয়া হয়েছে, সরকার থেকে তাদের সত্যি সত্যি ক্ষতিপূরণ দেবে—সেটা কেউই বিশ্বাস করে না। কিন্তু সত্যি সত্যি যদি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, আমি আমার পরিচিত সবাইকে নিয়ে রীতিমতো মিছিল করে এই ক্ষতিপূরণ আনতে যাব, সেটি সবাইকে জানিয়ে রাখছি। এই বিদঘুটে অসুখের জন্য মানুষের কী পরিমাণ কাজের ক্ষতি হয়েছে এবং দেশের কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, কেউ কি হিসাব করে দেখেছে?
পত্রপত্রিকায় দেখেছি, ঢাকা শহরে শুধু মশা মারার জন্য নাকি ৩৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। টাকা খরচ করা হলেই কাজ হয়—এ কথাটি আমাদের দেশের বেলায় খুব সত্যি নয়। আমাদের সিলেটে একটা বাইপাস সড়ক আছে, সড়কটা তৈরি হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি, এর এক পাশে ভেঙেচুরে খানাখন্দ তৈরি হচ্ছে এবং অন্যপাশে সেটাকে ঠিক করা হচ্ছে। এই বছরে হাওরে বন্যার সময় আমরা জেনেছি, কোটি কোটি টাকা খরচ করেও বন্যা ঠেকানোর বাঁধ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। গতকাল খবরে দেখেছি, ব্রিজ তৈরি করে সেটা উদ্বোধনের আগেই ধসে পড়েছে। এ রকম উদাহরণের কোনো অভাব নেই।
শুনেছি ৩৪ কোটি টাকা খরচ করেও কেনা কোনো মশা মারা সম্ভব হয়নি, সেটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সত্য-মিথ্যা জানি না, মশা মারার ওষুধ কেনার পর দেখা গেছে, ড্রামের ভেতর পরিষ্কার টলটলে পানি—এ রকম গল্পও শুনতে পাচ্ছি। আমার মনে হয়, ৩৪ কোটি টাকা খরচ করে অনেক সহজে মশা মারা সম্ভব। সিটি করপোরেশনের শুধু ঘোষণা দেবে যে কেউ যদি একটি এডিস মশা মেরে আনতে পারে, তাহলে তাকে একশ টাকা দেওয়া হবে! এক মশা মেরে একশ টাকা পাওয়া যাবে জানতে পারলে ঢাকা শহরের পাবলিকই মশা মেরে শেষ করে ফেলবে। এক মশা একশ টাকা হিসেবে ৩৪ কোটি টাকা দিয়ে একটি-দুটি নয় ৩৪ লাখ মশা মারা সম্ভব!
৩৪ লাখ মশা মেরে ঢাকা শহরকে চিকুনগুনিয়ামুক্ত করা যাবে কি না জানি না, কিন্তু সিটি করপোরেশন অন্ততপক্ষে বুকে থাবা দিয়ে ঘোষণা দিতে পারবে, তারা ৩৪ লাখ মশা মেরেছে।
আমরা যারা চিকুনগুনিয়ায় কাবু হয়ে আছি, তাহলে অন্তত একটুখানি হলেও শান্তি পেতাম।