শ্রদ্ধেয় করুণাময় গোস্বামী স্যারের কাছে আমার ঋণ

আমার পূর্বপুরুষ জন্মেছিলেন ভারতের মুর্শিদাবাদের সুন্দরপুর গ্রামে। কিন্তু থেকেছেন প্রথমে পাকিস্তানে পরে বাংলাদেশে। তাঁর বুকে ছিল অভিমানের চূড়ান্ত পাহাড়। প্রতীজ্ঞা ছিল পাসপোর্ট ভিসা হাতে নিয়ে কোনোদিন জন্মভূমির বুকে গিয়ে দাঁড়াবেন না। তাঁর হৃদয়ে ছিল গঙ্গা-যমুনার ক্ষরণ। সে ক্ষরণ আমরা অনুভব করতাম যখনই ভারত ভাগের বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো, আমরা দেখতাম স্বল্পবাক অসাধারণ ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটির অবরুদ্ধ ক্রন্দন সরব হয়ে উঠত কি প্রবল বেগে। দেশ ভাগের বেদনা অসংখ্য বিপর্যয় জীবনের মতো তিনিও বয়ে বেড়িয়েছেন আজীবন। সে বেদনা রক্ত কনিকায়, বংশ পরম্পরায়।
দেশভাগের বেদনার সে ইতিহাস নিয়ে সাহিত্যে বাংলা ভাষায় খুব বেশি কাজ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বরং এই অভিঘাত অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয় পাঞ্জাবে, উর্দু সাহিত্যে। অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী ৭০ বছর বয়সে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন যা তিনি তাঁর গোটা লেখক জীবনে করেননি। বিশাল ক্যানভাসে লাহরের পটভুমিকায় হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রিস্টান পাত্রপাত্রী ও জীবনের স্রোতে তাদের ভেসে যাওয়া অথবা তলিয়ে যাওয়ার কাহিনী নিয়ে লিখেছেন (২০১৫) ‘ভারতভাগের অশ্রুকণা।’ এটাই তাঁর প্রথম উপন্যাস। উপন্যাস সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছিলেন, লিখবার জন্য কোনো বিষয় নির্ধারণ করেননি। বিষয়ই আপনা থেকে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যে বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন তা কোনো নতুন বিষয় নয়। পুরাতন প্রেক্ষাপটে এক নতুন বিস্তার ঘটিয়েছেন। এ কাহিনী যাদের জীবনে ঘটেছে তারাই যে কেবল এর মর্ম বুঝবেন এমন নয়। উপন্যাস জুড়ে টুকরো টুকরো গল্প হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে। পাঠক মাত্রই বুঝবেন এর অর্থ নিতান্ত কল্পকাহিনী নয় বরং জীবন-পাথরের ঘর্ষণে জ্বলে উঠা চকমকি যা ক্ষনিকের জন্য হলেও, ক্ষত চিহ্ন রেখে যায় দীর্ঘ স্থায়ী। দুবছরেরও কম সময়ে তিনি লিখলেন সেই জীবনের হাহাকারকে কেন্দ্র করে ‘লাহরের রহিম খের।’ এউপন্যাসটি যেন লেখকের প্রথম উপন্যাসের ধারাবাহিক রচনা। উপন্যাস দুটির জন্য পাঠক হিসেবে আমি লেখকের কাছে ঋণী।
দেশভাগের দুঃখবোধ থেকে যেমন লেখকের মুক্তি নেই তেমনি মুক্তি নেই ‘রক্তপাত, হনন ও ধ্বংসময় এই ইতিহাসের নিমর্ম বলি শিকড়ছিন্ন অসংখ্য মানুষের।’ সেই অসংখ্য মানুষের হৃদয় তন্ত্রীর দাবি মেটাতেই তিনি মাস কয়েক আগে শুরু করে ছিলেন তাঁর তৃতীয় উপন্যাস। এক ঘরোয়া আড্ডায় অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী জানিয়ে ছিলেন দেশভাগের ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে পারছি না। তিনি যেন এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। ঘোরই বলব। নইলে আজীবন সংগীতে সমর্পিত গবেষক, শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সম্পাদক, কলাম লেখক করুণাময় গোস্বামী সারা জীবনে যে কাজটি করেননি সেই সৃষ্টিশীল কাজ অর্থাৎ উপন্যাস লেখা শুরু করলেন কেন? কোনো দিকে না তাকিয়ে এই কাজটিই করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সত্যিই এক আশ্চর্যের বিষয় বটে। এ সময়ে স্যারকে যতই দেখেছি ততই বিস্মিত হয়েছি।
স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৮৯ সালে নারায়ণগঞ্জের খানপুরে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বাংলোয়। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন শহীদ দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহার পুত্রবধূ শ্রীমতি সাহা। তিনি শ্রীমতি সাহা ও তাঁর স্বামী ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভবানী প্রসাদ সাহা রবির শিক্ষক। স্যারের সঙ্গে প্রথম আলাপেই আন্তরিকতা তৈরি হয়েছিল,স্নেহের বন্ধনটি ধীরে ধীরে দৃঢ় হয়েছিল। দনবীর রণদা প্রসাদ সাহার জন্মদিন উপলক্ষে তিনি মির্জাপুর এসেছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে। ভারতেশ্বরী হোমসের সাংস্কৃতিক বিভাগের আয়োজনে ছাত্রীদের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের অভিনয় দেখে তিনি অভিভুত হয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। কুমুদিনীর যেকোনো অনুষ্ঠানে, কাজে, সুখে-দুখে স্যারকে আমরা পাশে পেয়েছি একান্ত আপনজন হিসেবে। কুমুদিনী পরিবারের সঙ্গে স্যারের পরিবারের সম্পর্কটি অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ।
ড.করুণাময় গোস্বামী স্যার আমাকে উৎসাহীত করে বলেছিলেন, লেখালেখি কর আর আছ কুমুদিনীর সঙ্গে তাহলে রণদাপ্রসাদ সাহার জীবন কথা লিখছ না কেন? তাঁর জীবন সম্পর্কে লিখিত কোনো ইতিহাস নেই। এ উৎসাহ পেয়েছিলাম প্রিন্সিপাল প্রতিভা মুৎসুদ্দির কাছ থেকেও। ভারতেশ্বরী হোমসে যোগ দেওয়ার পর থেকেই দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহার প্রতি একটা অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ অনুভব করে এসেছি। লিখতে গিয়ে দেখলাম বড় কঠিন কাজ। একে তো লিখিত উপাদান বলতে অফিশিয়াল কাগজপত্র ছাড়া তেমন কিছুই নেই। মৌখিক ইতিহাস শুনতে গিয়ে দেখি কিংবদন্তির শ্যাওলা জড়িয়ে আছে সিংহভাগ। সেই কিংবদন্তির শ্যাওলা ছাড়িয়ে মূল ইতিহাস বের করে আনতে সাহায্য করেছিলেন দানবীরের কনিষ্ঠ কন্যা জয়াপতি, ডা. পতি ও প্রতিভা মুৎসুদ্দি। নানা ঐতিহাসিক তথ্য বিষেশ করে ১৯১৭ সালে প্রথম মহাযুদ্ধে পাকিস্তানের নওশেরায় ট্রেনিং ক্যাম্পে সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সৈনিক রণদাপ্রসাদ সাহার সাক্ষাৎ ও সখ্যতা গড়ে উঠেছিল- এ তথ্য দিয়ে সহায্য করে ছিলেন নজরুল বিষেশেজ্ঞ ড. করুণাময় গোস্বামী। পাণ্ডুলিপি দেখে পরিমার্জিত করেছিলেন নিস্বর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত বইটি এখন ‘চিরায়ত বাংলা গ্রন্থমালা’-এর অন্তর্ভুক্ত।
কুমুদিনীর নানা সংবাদ নিয়ে কুমুদিনী বার্তা শুরু করি ’৯৫এর শুরুতে। প্রতি সংখ্যাই স্যার সম্পাদনা করে দিতেন। সে সময়ে স্যারও কম ব্যাস্ত ছিলেন না। তোলারাম কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি সঙ্গীত ও সাহিত্য নিয়ে নানা মুখী গবেষনা কাজে নিজেকে নিয়েজিত রেখে ছিলেন। কোন দিন স্যারের বাসায় গিয়ে কাজ করেছি আবার কোন দিন তিনি নিজেই চলে আসতেন কুমুদিনীতে। স্যাররের মধ্যে কখনো বিরক্তি বা ক্লান্তি দেখিনি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের লেখা নিয়েও আলোচনা করতেন। দিন দিন কাজের চাপ বাড়ছে, বার্তার কাজটি বাড়তিই মনে হচ্ছিল। মনটা বিক্ষিপ্ত। স্যার বুঝলেন ব্যাপারটা। বললেন সব কিছু পজেটিভলি নেবে। দেখবে তখন আর কোন কষ্ট হচ্ছেনা। একাজটা থেকে তুমি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা শিখে যাচ্ছ এটাও তো একটা পাওয়া। একদিন বললেন আবৃত্তি কর কিন্তু গান করোনা কেন? বললাম আমার গানের গলা ভাল না। তিনি বললেন তাতে কি! গলা আমারও ভাল নয়। অন্যকে শোনাবার জন্য নয় নিজেকে শোনাবর জন্য গাইবে। দেখবে মন ভাল থাকবে। স্যার একদিন গুন গুন করে গাইছিলেন - আমার কোন কুলে আজ ভিড়ল তরী - শেষের দিকে গলা ছেড়েই। কন্ঠ ভিজে উঠেছিল অপূর্ব দরদে।
২০০১ সালে কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার সময় দেশের প্রধান পত্রিকাগুলোর জন্য ক্রোড়পত্র রচনা করে দিয়েছিলেন করুণাময় স্যার। ২০১৩ সালে রণদাপ্রসাদ সাহা স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ হল। সম্পদনা পরিষদে আনিসুজ্জামান, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, করুণাময় গোস্বামী, দ্বিজেন শর্মা, মফিদুল হক সঙ্গে আমি। সে সময়ে স্যারের সাহায্য পেয়েছি অফুরন্ত। এমনি করে স্যারের কাছে আমার ঋণের পরিমাণই বেড়েছে কেবল।
উৎসব-পার্বণে সব সময় স্যার টেলিফোন করতেন। ২৬ জুন রাতে সাড়ে ৮টার দিকে স্যারের সঙ্গে আমার শেষ কথা বলা। অনেক্ষণ কথা হয়েছিল। নতুন উপন্যাসটি নিয়ে তিনি খুব উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষভাবে জানিয়ে রেখেছিলেন খুলনা থেকে ফিরে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তখন তো বুঝতে পারিনি স্যারের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না, কথা হবে না। তিনি তো চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত ছিলেন না বরং সৃষ্টি সুখের আনন্দে সদানন্দ ছিলেন। মফিদুল হক ভায়ের কথায় বলতে চাই তিনি আমাদের আকাশপ্রদীপ ছিলেন, ঘনায়মান সন্ধ্যাকালে যে প্রদীপ গৃহ-আঙিনায় প্রোথিত থেকে উঠে যায় ওপরে, আলোক ছড়ায় অনন্ত আকাশ থেকে, পিতৃপুরুষের সঙ্গে পরম্পরায় উদ্ভাসিত করে জীবন, যোগসূত্র রচনা করে আমাদের সঙ্গে ইতিহাসের। সব অক্ষমতা-বর্বরতা-নৃশংসতা পেরিয়ে মানবের জাগরণী গান তিনি আমাদের শুনিয়েছেন। স্যারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।।
লেখক : গল্পকার ও শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল।