শুধু প্রবৃদ্ধির সন্তুষ্টি?

যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে গত ৫ অক্টোবর বসেছিল চাকরি মেলা। ঢাকা হতে ৩০টি মতো দেশি-বিদেশি কোম্পানি এতে অংশ নেয় কর্মী নিয়োগ দেবে বলে। কথা ছিল প্রার্থীরা মেলায় এসে কোম্পানিগুলোর স্টল ঘুরে কোথায় কী চাকরি-যোগ্যতা ইত্যাদি জেনে উপযুক্ত জায়গায় সিভি জমা দেবে। এরপর তা বাছাই করে স্পট ইন্টারভিউয়ে প্রাথমিক প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। কিন্তু প্রার্থীদের জনসমুদ্রের স্রোতে ভেস্তে গেছে এই পরিকল্পনা। পরিস্থিতি সামলাতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। মেলার ভেতরে ঢুকতে না পেরে পুলিশের কাছে দিয়ে, গেটের দিকে ছুড়ে সিভি ফেলে যায় প্রার্থীরা। দিন শেষে হাজার হাজার সিভির স্তূপ জমে পাহাড় হয়ে যায়।
এই হলো উন্নয়নের পথে হেঁটে চলা বাংলাদেশের বাস্তবতা। দেশের প্রবৃদ্ধির যে ধারার কথা সরকার প্রচার করে বা আমরা শুনি তার সাথে এই চিত্র মিলে? মিলে না। যশোরের এই সিভির পাহাড় আমাদের জানিয়ে দেয় দেশের শিক্ষিত তরুণ আর মান সম্পন্ন কাজ নয়, কোনো রকমে একটা কাজ চায়। আমরা প্রবৃদ্ধি নিয়ে বড় বেশি চিৎকার করছি। কিন্তু কর্মসংস্থান কমেছে। এই জবলেস গ্রোথ বা কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি নিয়ে বড় ভাবনা প্রয়োজন নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে।
কী করে একটা চাকরি জুটবে, তারই চিন্তায় রাত জাগে লাখ লাখ শিক্ষিত ছেলেমেয়ে। চাকরি না পেয়ে অনেকেই মানসিক অবসাদে ভোগে। প্রতিবছর যে বিপুল তরুণ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বের হচ্ছে, তাদের সিংহ ভাগই থেকে যাচ্ছে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের বাইরে। শিক্ষিত মানুষের বেকারত্ব আসলে সম্পদের অপচয়। দেশের তারুণ্যের এক তৃতীয়াংশ যদি কর্মহীন থাকে তবে প্রবৃদ্ধি দিয়ে উন্নয়ন হবে কতটুকু?১৬ কোটির দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ১৮.৮ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি। বছরে ৩০ লাখ যুবকের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, সেটা চাকরি কিংবা ব্যবসা যাই হোক না কেন।
দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর ২৬-৩০ লাখ যুবক প্রবেশ করে। সরকার প্রতি বছর নিয়ম করে কিছু চাকরির ব্যবস্থা করে। কিন্তু বিপুল চাহিদার বড় অংশই প্রত্যাশা করে বেসরকারি খাতের কাছে। কিন্তু সেখানে এখন কোন প্রাণচাঞ্চল্য নেই। শুধু চাকুরি নয়, আত্মনির্ভরতার কথা বলেন অনেকেই। কিন্তু আত্মনির্ভর হতে গেলে ব্যবসা করতে হবে। ব্যবসায়ের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না থাকায় সব শ্রেণির বেকার ব্যবসায়ে আগ্রহী হয় না। তা ছাড়া ব্যবসায়ের জন্য পুঁজির প্রয়োজন যা ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া যায় না। ফলে নতুন উদ্যোগতা তৈরি হচ্ছে না। শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী চাকরির প্রতি তাই বেশি আগ্রহী। কিন্তু প্রতিবছরই কমছে সেই সুযোগ।
বাংলাদেশে এখন সামগ্রিক বেকারত্বের হার চার শতাংশেরও বেশি। তবে যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৬.৮ শতাংশ, নারী বেকারত্বের হার ৮.৫ শতাংশ। এই হার উদ্বেগজনক। প্রাথমিক বা জুনিয়র পর্যায়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে যারা তারা বেশি বেকার থাকছে।
সরকার প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নের কথা বেশ জোরেশোরেই বলছে। পোশাকশিল্প নির্ভর রপ্তানি বাজারে গতি আছে, তাই আর কোনো খাত নিয়ে তেমন মাথা ঘামাবার দরকার নেই। অল্প কিছু মানুষ ভালো আছে, তাদের জন্য সম্ভোগশিল্প ও সেবার বিপুল বিস্তার। তাদের বেতন বাড়ল, এরা সাচ্ছল্যের মুখ দেখলেন, আরাম-ব্যসনে অভ্যস্ত হলেন, ক্রিকেট খেলায় মাতলেন। অন্য পক্ষে বেশির ভাগ মানুষের আয় ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। সরকারকে ঘিরে যে পণ্ডিতবর্গ বিরাজ করেন তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু, জাতীয় উপার্জনের বার্ষিক হার কোন স্তরে থাকবে, কত দশমিক কত হবে, তা নিয়ে।
গোটা শিল্পব্যবস্থা সংকীর্ণতর হচ্ছে। কর্মসংস্থান সেই তিমিরেই। দেশে বিদেশে রেড-শো হয়, কিন্তু এসব শোতে যেতে আসতে যে খরচ হয় সেই প্লেন ভাড়া উঠে কি না, তারও জবাবদিহিতা নেই। সরকারের পরম নির্লিপ্ত ভাব, অর্থমন্ত্রণালয় ও মুদ্রা ব্যবস্থার সর্বেসর্বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো ভাবনা চোখে পড়ে না কি করে বিনিয়োগ চাঞ্চল্য আনা যায়। শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলে সুযোগসন্ধানী মানুষের হাতে সর্বস্ব হারালেন সাধারণ মানুষ।
দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দূরস্থান। জমি, গ্যাস আর বিদ্যুতের সমস্যায় যারা ব্যবসা-বাণিজ্য আর শিল্পে আছেন, তারাই পালাবার পথ খুঁজছেন। অভূতপূর্ব, ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি, কিন্তু সরকার ধ্যানমগ্ন। আমলাতন্ত্র আর কিছু মানুষ সম্ভোগে ব্যস্ত, ঝলমল করে বাজে রাস্তার ওপর দাঁড়ানো রেস্তোরাঁ, আনন্দ-হুল্লোড় হয়। যেন কোনো ব্যথা নেই পৃথিবীতে।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার হতাশাব্যঞ্জক। বিনিয়োগ বাড়িয়ে সেটা কিছুটা সামাল দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তার লক্ষণ নেই। আমলাতন্ত্রের মারপ্যাঁচে, অবকাঠামোর পুঁজি খাটিয়ে কেন ব্যর্থ মনোরথ হতে যাবেন শিল্পোদ্যোক্তারা? দেশে অর্থব্যবস্থা একটি শ্বাসরোধকারী বৃত্তের মধ্যে বাঁধা পড়ে গেছে। লুটপাটে আর্থিক খাত বিধ্বস্ত। উৎপাদন-শিল্পের উন্নতির জন্য যা প্রথম প্রয়োজন, তার নাম পরিবেশ। বিনিয়োগের পরিবেশ। বাংলাদেশে এই বস্তুটির সবিশেষ অভাব। বিশেষত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য। এই দেশে খাতায় কলমে লাইসেন্স রাজের অবসান হলেও, আসলে হয়নি। ফলে, কোনো একটি শিল্প গড়তে হলে বিনিয়োগকারীকে কত যে পথ পেরোতে হয়, কত যে আইনের দাবি মেটাতে হয় তা যারা ভুক্তভোগি কেবল তারাই জানে।
স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীদের পক্ষে অর্থায়নের ব্যাংকের জটিল সব চাহিদা, অবকাঠামো সুবিধার জন্য দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা মহা বিড়ম্বনা। বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা এই কাজ করবার জন্য আলাদা লোক রাখতে পারেন। মার খায় ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো। বক্তৃতায় মন্ত্রীরা যতই বলেন ক্ষুদ্র, মাঝারি বিনিয়োগকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে, তাদের জন্য অধিক যত্নের ব্যবস্থা করতে হবে, বাস্তবে তার অনুপস্থিতি ততই বেশি। কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পের বিকল্প নেই জেনেও কোনো উদ্যোগ নেই কোনো স্থান থেকেই। সন্তুষ্টি কেবল প্রবৃদ্ধ নিয়ে? তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করতে হবে। একদিকে বেকারত্ব সমস্যা যেমন আছে, তেমনি অন্যদিকে শিল্প-কল-কারখানায় দক্ষ লোকের অভাবও বিদ্যমান। দেশের বিভিন্ন কোম্পানির বহু পদে বিদেশিরা কর্মরত। অতএব, কাজের বাজারের চাহিদার সহিত শিক্ষাব্যবস্থাকেও সঙ্গতিপূর্ণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন কারিগরি ও বিশেষায়িত শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকতর জোর দেওয়া।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি