‘ঢাকা অ্যাটাক’ ও আমাদের চলচ্চিত্র

‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবিটি দেখলাম। বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্স-এ চরম বৈরী আবহাওয়ায়ও হল কানায় কানায় ভরে যাচ্ছে প্রতিটি শো। চলচ্চিত্র হিসেবে এটি কেমন হয়েছে সেই বিশ্লেষণে গেলে অনেক অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলা সম্ভব। আমি এখানে তা করছি না। মানুষ ছবিটি দেখছে। এবং একটি ছবি নির্মাণ করে প্রযোজক, পরিচালক ও হল মালিকরা আফসোস করছেন না যে তাদের বিনিয়োগ বৃথা গেছে।
প্রায়ই আলোচনা হয় যে, একটা সময় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়মিত ছুটত সিনেমা হলে। কিন্তু কয়েক দশক ধরে চলচ্চিত্রশিল্পে ধস নেমেছে। দর্শক বাড়লেও তারা হলমুখী হচ্ছে না। ঘরে বসে তারা বিকল্প মাধ্যমে ছবি দেখছে। কেউ বলছেন, চলচ্চিত্রের মান নেই, হলের দুরবস্থা, দর্শক-চাহিদা না বুঝতে পারা, শিল্পীদের নিষ্ঠার অভাব আবার ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও রয়েছে পাইরেসি, ভ্যাট-ট্যাক্সের চাপ ইত্যাদি।
পরিচালক দীপংকর দীপন এসব কিছু মাথায় রেখেই ছবি করেছেন এবং সফল হয়েছেন। অভিনন্দন জানাতে হয় তাঁকে। তিনি বাংলা ছবিতে নতুনত্ব আনার ভালো চেষ্টা করেছেন। সপরিবারে দেখার মতো বাংলা ছবির আকালের দিনে একটা পরিচ্ছন্ন ছবি উপহার দিয়েছেন।
কিছুদিন আগেই যৌথ প্রযোজনার ছবিসহ সামগ্রিক দশা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে নানা স্তরে। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা নানা অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু যে কথাটা আলোচনায় আসে না, তা হলো হলের অবস্থা। বাণিজ্যিক ছবির মরা বাজারে সিঙ্গেল স্ক্রিন হলগুলোর অবস্থা ক্রমেই পড়তির দিকে। সারা দেশে সিঙ্গেল স্ক্রিন হলের সংখ্যা শুধুই কমছে। সাধারণভাবে এফডিসিতে যেসব ছবি উৎপাদিত হয়, সেগুলো দিয়ে হল বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে না, কারণ মানুষ সেগুলো দেখতে হলে আসছে না। এমন অবস্থাতেই হল মালিকরা বাঁচবার হিসাব করছিলেন দু-একটি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ছবি চালানোর মধ্য দিয়ে। সেটা অবশ্য বন্ধ হলো পেশিশক্তির কাছে হার মেনে। সিদ্ধান্ত যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা কিন্তু প্রায় মৃত হলমালিকরা বাঁচবেন কী করে সেই সমাধান দেননি।
বস্তাপচা কাহিনী, দুর্বল নির্মাণ, সম্পাদনার যেসব অভিযোগ আছে, আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে তা বলা যাবে না দীপনের ছবি নিয়ে। এফডিসিতে বলবান নির্মাতারা যখন ভেবেছেন ঘাম-চিটচিট শরীরে সিনেমা দেখবে মানুষ, তখন ভিন্ন ভাবনা থেকে ছবি তৈরি করেছেন তিনি। মানুষকে হলমুখো করতে হবে এটাই বাস্তবতা। এ শিল্পের কর্ণধারদের মনোজগতে বৈকল্য থাকার কারণে অনেক দিন আগেই ‘ভদ্রলোকেরা’ হলে যাওয়া ছেড়েছে। পরিবার নিয়ে কেউ আর যায় না ছবি দেখতে। আসলে গোটা চলচ্চিত্রপাড়াটা পাড়াই থেকে গেল, শিল্প হতে পারল না।
হল শুধু কমছেই না, হলগুলোর ইমেজও সুবিধের নয়। এগুলো হয়ে উঠেছে সমাজবিরোধীদের বিনোদন কারখানা। চলচ্চিত্র হলো একটি জাতির সৃজনশীল বহিঃপ্রকাশ। এখন যারা এফডিসিতে ছবি নির্মাণ করছে, সেখানে সংস্কৃতি আছে কি না দেখতে হবে। বলা হয় ভালো গল্পের অভাব। কিন্তু গল্প আসবে কোথা থেকে? সংস্কৃতির চর্চা যাঁরা করেন, তাঁদের সঙ্গে ওঠাবসা নেই এফডিসিকেন্দ্রিক চক্রের। আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ওঠাবসা নেই প্রযুক্তির সঙ্গেও। এখানে হিরো-হিরোইন উভয়ই প্রযোজক ধরে আনেন। প্রযোজক নিয়ে আসেন এবং প্রযোজক তাঁর সম্পূর্ণ প্রভাব পরিচালকদের ওপর চাপান। প্রযোজক যাঁকে নিতে বলছেন, তাঁকেই নিতে হচ্ছে, ছবির ধরনও বলে দিচ্ছেন প্রযোজক।
যে কথা বলছিলাম, প্রথম কাজ হল বাঁচানো। প্রায়ই শুনতে হয় একের পর এক হল বন্ধের খবর। ঢালিউডে চলচ্চিত্রের চেয়ে বেশি নোংরা রাজনীতি। কে কাকে বহিষ্কার করছে, কে কাকে হুমকি দিচ্ছে, এসব ছাড়া কোনো গল্প নেই এই পাড়ায়। এই পাড়া সিনেমার জগৎ হয়ে ওঠবে কে জানে?
সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো সুস্থতার লক্ষণ নয়। প্রযুক্তির প্রসার ও উপযুক্ত ব্যবহার বাংলা সিনেমায় কেউ কি দেখছে? যেসব প্রিন্টের ছবি এ দেশের দর্শকদের দেখানো হয়, সেগুলোকে নোংরা লাগে এ যুগের ঝাঁ-চকচকে চলচ্চিত্রের ডিজিটাল প্রিন্টের সঙ্গে তুলনা করলে। বিদেশের বাজার তো অনেক দূরের ব্যাপার, দেশের বাজারেই ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে এফডিসির চলচ্চিত্র এখনো সেই গলিঘুপচির জায়গাতেই পড়ে রয়েছে। বিষয়টা শুধুই অর্থনৈতিক নয়। অনেক বেশি শিক্ষা আর রুচির।
ভালো ছায়াছবির চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। আমরাই জোগান দিতে বিমুখ। প্রত্যক্ষ ক্ষতি হলো হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরোক্ষ ক্ষতিও কম নেই। যাঁরা ভালো পরিচালক আছেন, যাঁরা মানসম্মত কিছু করতে চান, তাঁরা আর প্রবেশাধিকার পান না এই গোষ্ঠীগত রাজনীতির কারণে। প্রতিদিন অনেক সম্ভাবনাকে গলা টিপে ধরছে এই অপশক্তি।
বাংলা ছবি কোনো রকমে ভেসে আছে ছোট পুকুরে। তাকে বড় পুকুরে পৌঁছে দিতে না পারলে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সবার ভালোলাগার মতো ছবি তো চাই। সঙ্গে পুরোনো সিনেমা হলের স্বাস্থ্যও ফেরাতে হবে। শিল্প পরিবেশনের জায়গা না বাঁচলে শিল্প নিজে বাঁচবে কী করে?
জনগোষ্ঠীই শিল্পের সবচেয়ে বড় বিচারক। সিনেমা মানুষের। চলচ্চিত্রের উৎসব মানুষের, অসাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর নয়। আমাদের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এ জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু বাণিজ্যিকীকরণ, সুস্থ ও রুচিশীল বিনিয়োগ এখানে আনতে না পারলে চলচ্চিত্র কখনো সেই মানুষের হবে না। সবার হলে গিয়ে দেখা উচিত। সিনেমা হলবিমুখ মধ্যবিত্ত দর্শকদের হলে ফেরত নিতে না পারলে এ দেশে চলচ্চিত্রের মূল স্রোতের শুদ্ধিকরণ সম্ভব হবে না।
লেখক : পরিচালক (বার্তা), একাত্তর টিভি