অভিমত
ভোটের কাহন

নতুন বছরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হতে যাচ্ছে ভোট। কারণ, এ বছরটিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে ধারণা করছে রাজনৈতিক মহল। প্রতি পাঁচ বছর পর পর একটি করে নির্বাচন হবে, জনগণের রায়ে নতুন সরকার আসবে, তা প্রত্যাশিত। কিন্তু এই নির্বাচন নিয়ে এত আলোচনার কারণ হলো ২০১৪-এ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক জ্বালাও-পোড়াও করেও সরকারকে আগে নির্বাচন দিতে বাধ্য করতে পারেনি।
ভোটের কথা সাতকাহন, কিন্তু কাজের কথা কী? সবাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। কিন্তু ভোটের চাওয়াটাই সব নয়। মূল প্রশ্ন আরো গভীরে। বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন, বাংলাদেশকে বাংলাদেশে থাকার প্রশ্ন, রাষ্ট্র হিসেবে কার্যকার থাকার প্রশ্ন। এমন সব ঝুঁকি নিয়েই উদার, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্বাচনে যাচ্ছে, যেখানে আবারো মূল নিয়ামক হয়ে দাঁড়াতে পারে ১৯৭১। আসলে এবারের নির্বাচন আবারও ১৯৭০-এর নির্বাচনের মতো, আবারও বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রামের মতোই রাজনীতির অঙ্ককে জাতির সামনে উপস্থিত করেছে।
কোন পরিপ্রেক্ষিতে সে বছর একতরফা নির্বাচন হয়েছিল, তা মূলত সবার জানা। ২০০৮-এর নির্বাচনের পর সরকার গঠন করার পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে সরকারের সমস্যা শুরু। প্রথমে দুই মাসের মধ্যে চেষ্টা করা হয়েছে বিডিআর বিদ্রোহের মতো ঘটনা ঘটিয়ে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক নষ্ট করে সরকার উচ্ছেদের। এরপর যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে নতুন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বিচারবিরোধী শক্তি। সে যুদ্ধ এখনো চলমান। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা থেকেই আস্তিক-নাস্তিকের সাম্প্রদায়িক খেলা, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, শিয়া, আহমদিয়া সম্প্রদায়কে আঘাতের মাধ্যমে মুসলমানদের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা, রাজপথে বিদেশি নাগরিক হত্যা এবং হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর মতো চূড়ান্ত হামলা।
এত সব অত্যন্ত দক্ষ ও শক্ত হাতে মোকাবিলার পরও সামগ্রিক ছবিটা সরকারের অনুকূলে নেই পুরোপুরি। কী করলে এই ছবিটা বদলাতে পারে? যেকোনো আলোচনায় দুর্নীতির অজস্র অভিযোগ। কিন্তু দুর্নীতি আটকাতে কী করেছে সরকার? অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, এমপিকে জেলে পাঠিয়েছে, মন্ত্রীর ছেলেকে আটক করেছে, ডাকসাইটে ব্যাংক চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ছবিটা বদলাতে পারেনি। তাই সরকারের সামনে এই বছরটা স্বচ্ছতা নামের এক নতুন ছবি নির্মাণের বছর।
রাজনীতিতে অনেক সময় পাটিগণিত অপ্রযোজ্য। এই ময়দানে সব সময় দুই আর দুইয়ে চার হয় না। পাঁচ বা সাড়ে পাঁচও হওয়াতে হয়। দুই বড় পক্ষে জোটের নামে অসংখ্য সংখ্যা। তবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যা অল্পই। বিএনপির বড় মিত্র জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের মতো একটি গোঁড়া ধর্মীয় গোষ্ঠী। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জন্য জাতীয় পার্টি ও বাম দলগুলো। হেফাজতের চরিত্রটা জানার পরও আওয়ামী লীগ কেন তার সঙ্গে অঙ্ক করতে গেছে তা শুধু দলের শীর্ষ পর্যায়ই বলতে পারবে। বাম সংগঠনগুলোর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী অবস্থানের কারণেই তাদের পক্ষে জামায়াত, হেফাজতের ধারেকাছে যাওয়া সম্ভব নয়। এটা জেনেও অর্থমন্ত্রী যখন এদের ন্যায্য প্রতিবাদকে রাবিশ বা ননসেন্স বলেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে রাজনৈতিক অস্থিরতার ময়দানে তিনি একজন অনভিজ্ঞ গুরুজন। বামদের সংখ্যাই সবকিছু নয়। সমাজের অনেক ক্ষেত্রে এদের ভূমিকার কারণেই ভাগ্যে আঁচড় পড়তে পারে, সে কথা মাথায় রাখাই উত্তম।
২০০৮-এর নির্বাচনের ভোট ভাগের হিসাব আসন্ন নির্বাচনে অপরিবর্তিত থাকবে, ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। বিশেষত, গত নির্বাচনে দেশজুড়ে ওঠা বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতি ও তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণাধীন হাওয়া ভবনবিরোধী ঝড়ের আঁচ পড়েছিল, এবং আওয়ামী লীগের দিকেই ঝুঁকেছিল আপমার মানুষ। কিন্তু গত নয় বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হওয়া বিভিন্ন নির্বাচনের ফলকে মাপকাঠি মানলে, বিশেষ করে সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনী ফলের দিকে তাকালে স্বীকার করতেই হবে, সেই ঝড়ের প্রাবল্য প্রায় উবে গিয়েছে। গোটা দেশের ধারা বজায় থাকলে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট কমতে পারে। সেই ভোট কোন দিকে যাবে, তার জন্য বড় অঙ্কবিদ হতে হয় না। কারণ কোনো তৃতীয় জোট বড় হয়ে উঠতে পারেনি।
রাজনীতির ময়দানে ঠিক কী চলছে, সেটা বিবেচনা করে এগোনোতেই আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল বা বৃহত্তর অর্থে মহাজোটের ভাগ্য। যদি একেবারে নিচু স্তর থেকে দলের কর্মীরা দলকে মানেন, যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক, সেটা মেনে দলের স্বার্থে কাজ করেন, ঐক্য বজায় রাখেন একমাত্র তখনই বর্তমান শাসক দল সফল হতে পারে। কিন্তু গত নয় বছরে আওয়ামী লীগের প্রায় প্রতিটি স্তরেই বিরোধের ইতিহাস এখন অনেক দীর্ঘ। কাজেই, নির্বাচনী যুদ্ধ পার করতে হলে কর্মীদের সেই বৈরিতার কথা ভুলতে হবে। আর ভোলার জন্য যথেষ্ট কারণ চাই। আওয়ামী লীগ সেই কারণটি সৃষ্টি করতে পারবে কি না, সেটাই মূল প্রশ্ন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা বরাদ্দ করে প্রান্তিক পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে যে তিক্ত বিরোধ রচনা করা হয়েছে, তা দ্রুত মেটাতে না পারলে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
রাজনীতির ময়দানে মতাদর্শই একমাত্র চালিকাশক্তি নয়। বাংলাদেশে অনেক মতাদর্শগত লড়াই আমরা দেখেছি। কিন্তু রাজনীতির খেলায় আরো বড় শক্তির নাম অর্থনীতি। কেন বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুদ্র প্রত্যক্ষ প্রাপ্তিকেই বেশি গুরুত্ব দেন, সেই প্রশ্নের উত্তর বহুমাত্রিক। দেখা যাচ্ছে বড় উন্নয়নযজ্ঞের পরও অর্থনীতি মানুষের আলোচনায়। বিশেষ করে চালের দাম। মানুষ উন্নয়ন চায়। কিন্তু বেশি বোঝে ব্যক্তিগত আর্থিক লাভ-ক্ষতি। উন্নয়নের পরও দ্রব্যমূল্য তাকে সরকারি দলে থেকে দূরে ঠেলে দিল কি না সেই বিচার জরুরি।
অর্থনীতির এসব হিসাবের পাশাপাশি থাকছে আরো কয়েকটি প্রশ্ন। যেমন—সীমান্ত হত্যা, আসামে অনুপ্রবেশের নামের ভারতীয় মুসলমানদের খেদিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, রোহিঙ্গা সমস্যা। এসবই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চোরা স্রোতকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসবে। তখন অবধারিতভাবে ভোটের মেরুকরণ বলে দেবে কার কোথায় লাভ আর ক্ষতি। ছোট প্রশ্নগুলোকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়ে বিচার করলে হয়তো নতুন পথের সন্ধান পেলেও পেতে পারে আওয়ামী লীগ।
লেখক : পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি।