গাছ খুন কেন?

বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি কি উন্নয়ন ফর্মুলার কাছে বন্দি করে রাখা আছে? অবস্থাদৃষ্টে তা-ই মনে হয়। উন্নয়নের নামে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন যেন এই মাটির সংস্কৃতি। এ অবস্থা ঢাকায় হয়েছে, চট্টগ্রামে হয়েছে, সারাদেশে হয়েছে এবং হতে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিধৌত বেনাপোলের যশোর রোডে। পরিবেশকে গুরুত্ব না-দেওয়া ও শত প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করার আশ্চর্য মিল আছে জামাত-বিএনপি জোট কিংবা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মনঃস্তত্বে। সামাজিক মাধ্যমে লিখে মানুষ, কেউ পথে মানববন্ধন করে, কিন্তু সবই টেলিভিশন, অনলাইন আর কাগজের শিরোনাম থেকে যায়। রাজনৈতিক ও সরকারি অচলায়তন পরিবেশকে কোনো পাত্তা না দেওয়ার মানসিকতাও সংহত থাকে এতসব প্রতিবাদের মুখে, সব আমলে।
প্রসিদ্ধ যশোর রোড চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হচ্ছে শিগগিরই। এ জন্য সড়কটির দুই পাশে থাকা নতুন-পুরোনো আড়াই হাজারের মতো গাছ কেটে ফেলা হবে। এসব গাছের মধ্যে শতবর্ষী গাছ আছে একশরও বেশি। গত ৬ জানুয়ারি এক সভায় এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। গুরুত্বপূর্ণ যশোর-বেনাপোল মহাসড়কটি (যশোর রোড) চার লেনে উন্নীতকরণের জন্যই গাছ কাটার উৎসবে একমত হয়েছে রাজনীতিক, প্রশাসনের লোকসহ প্রকৌশলীরা।
এই মহাসড়কটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটিশ শাসন আমলে যশোর শহরে একটি বিমানঘাঁটি ছিল। ফলে সেই সময় এই বিমানঘাঁটির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি করার জন্য যশোর রোডের আধুনিকভাবে নির্মাণ করা হয়। সেই সময় অনেক গাছ লাগানো হয় রাস্তার দুই পাশে। বর্তমানে যশোর রোড বলতে দমদম থেকে বনগাঁয়ের পেট্রোপোল সীমান্ত পর্যন্ত মহাসড়ককে বোঝায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই যশোর রোড দিয়েই লাখ-লাখ শরণার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শরণার্থীদের সেই ঢল নিয়ে বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে একটি কবিতা লিখেন। পরবর্তী সময়ে এটি ঐতিহাসিক একটি গানে পরিণত হয়।
ওপারের যশোর রোডে মানুষের দাবির মুখে গাছ কাটা স্থগিত রেখে গাছ মাঝখানে রেখে দুই পাশে রাস্তা প্রশস্ত করার কাজ করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু এপারে, আমাদের দিকে গাছ খুনের পক্ষেই দৃঢ় অবস্থান। যশোর রোডের অক্সিজেন কমিয়ে আনতে বদ্ধ পরিকর এখানকার সব সংশ্লিষ্ট পক্ষ। কারণ বোঝাই যায় যে, এতগুলো পুরোনো গাছ। এসবের দাম হরিলুটের এই সুযোগ কোনো নীতি কথায় আটকাবে বলে মনে হয় না। যশোরের সড়ক ও জনপথ বিভাগ বলছে, যেভাবে প্রকল্পটি পাস হয়েছে ঠিক সেভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে গাছ কাটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু গাছগুলো রেখে বিকল্প কোনো পদ্ধতিতে রাস্তা সম্প্রসারণের নকশা বা প্রকল্প করা যেত কি না- এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর কেউ দিচ্ছে না।
যাবতীয় প্রশ্ন ও নিয়ম শিকেয় তুলে কয়েকশ বছর পুরোনো গাছের গায়ে কুড়ালের আঘাত করতে এদের হৃদয় এতটুকু শংকিত হবে না। যশোরে সবুজ ধ্বংসের প্রতিবাদে সারা দেশের মানুষ আজ একাট্টা। এ নতুন নয়। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সরকার বা সরকারি সংস্থা আইন ভেঙে গাছ কাটছে! কোথাও ফ্লাইওভারের জন্য, কোথাও রাস্তা বাড়াতে, কোথাও বা সরকারি স্থাপনা বানাতে। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গাছ কাটার অভ্যাস পাকাপোক্ত হচ্ছে বাংলাদেশে।
সরকারি ও দলীয় লোকজন তো বটেই, কিছু অতি উৎসাহী লোকজনও বলেন তা হলে কি উন্নয়ন হবে না? এসব মূঢ়কে হয়তো পাল্টা প্রশ্ন করা যায় ‘উন্নয়ন কাকে বলে’? কিন্তু সেই বিতর্কে না ঢুকেও বলা যায়, নিশ্চয়ই গাছ কাটতে হয়, জলাশয় ভরাট করতে হয়। কিন্তু বিকল্প যদি থাকে তবে কি তা মানা হবে না? বৃক্ষ নিধনের যৌক্তিক কারণও কি তুলে ধরা হয়েছে জনগণের সামনে? উন্নয়ন এ দেশে আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। অন্য দেশের উন্নয়নও আজ মানুষ দেখতে পারে, জানতে পারে। এমন নজিরও আছে যে, একটি গাছকে সযত্নে বাঁচিয়ে বাড়ির দেওয়াল ফুটো করে গাছটিকে আকাশ দেখার পথ প্রশস্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ আজ জলবায়ু সম্মেলনে বড় বিতর্কে অংশ নেয়। অনেক কথা বলে। কিন্তু সেই বাংলাদেশে আজ এমন নির্বিচার প্রকৃতি বিনাশী কাজও হয়। জলবায়ু সম্মেলনে আমরা উচ্চকণ্ঠে কথা বলি, আবার নিজেরা সাহারা হওয়ার পথে নিজেদের এগিয়ে নেই। এই বিপরীত অবস্থান সত্যিকার অর্থে নৈতিক নয়। ক্রমবর্ধমান কার্বন-ডাই অক্সাইড বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস সামলাতে, রেকর্ড ভাঙা উষ্ণায়ন থামাতে গাছই যে অন্যতম ভরসা, তা বুঝছে সবাই। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আমাদের দেশে উল্টো খেলা। এক দিকে ঘটা করে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালিত হয়, অন্যদিকে নীরবে, অপ্রয়োজনে গাছ কেটে সাবাড় করা হয়।
আমরা উন্নয়ন চাই। কিন্তু তা গাছ কেটে নয়। আমরা চাইছি সবুজ উন্নয়ন। গাছগুলোকে মাঝখানে রেখে দুই পাশের রাস্তা চওড়া করা হোক। যশোর রোড়ের ধারে এই প্রাচীন গাছগুলোর কোনো বিকল্প হতে পারে না। একটি গাছ কেটে যদি তার পরিবর্তে ২০০টি গাছও লাগানো হয়, তাও এর সমতুল্য হবে না বলেই মনে করি।
কর্তৃপক্ষ চাইলেই গাছগুলো রক্ষা করতে পারেন। এই রাস্তার দুই পাশেই ৫০ ফুটের মত খালি জায়গা রয়েছে। যেটা সহজে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বুঝতেতো কষ্ট হয়না যে, রাস্তা সম্প্রসারণের চেয়ে একটা মহলের বেশি আগ্রহ রয়েছে গাছ কেটে লুটপাট করার। ঠিক এখানেই পরিবেশবিদদের ভূমিকা নেওয়া উচিত। সামাজিক মাধ্যমে ঝড় আছে ঠিকই। কিন্তু এখন দরকার একটি রিট। উপযুক্ত তথ্য জোগাড়ের মাধ্যমে সরকারের অপ্রয়োজনীয় ও বেআইনী পরিকল্পনাকে আইনীভাবে মোকাবিলা করা। যশোর রোডের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ আছে, কিন্তু নেই বিশিষ্টজন ও বুদ্ধিজীবীরা যারা সরকারি হালুয়া রুটির ভাগবাটোয়ারায় ব্যস্ত। এই বাংলাদেশ উষ্ণ হবে, নদী শুকোবে, যত জঞ্জাল উপচে পড়বে, বৃক্ষহীন হবে সব পথ আর এরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ক্ষমতার কেন্দ্র থাকা মানুষজনের পাশে বসে গরম পেয়ালা ও ঠান্ডা গ্লাসে চুমুক দিয়ে হাসবে।
লেখক : পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি