প্রতিক্রিয়া
ঘৃণা আর হত্যা যে আদর্শের মূল স্তম্ভ

আবার হামলা, আবার আতঙ্ক, আবারও অন্ধকারের শক্তির আস্ফালন। সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়েছে। তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, যেমন করে হত্যা করা হয়েছে হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায়, দীপনসহ অসংখ্য লেখক ও বুদ্ধিজীবীকে, হত্যাচেষ্টার কায়দা একই। পেছন থেকে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। এরা পেছন থেকে আঘাত করে, কারণ এরা জাতিকে পেছনে টানতে চায়। এরা অন্ধকারের শক্তি, অন্ধকারেই এরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করেছিল ১৯৭১-এ।
রাজনৈতিক ইসলামের জঙ্গি, ওয়াহাবি-সালাফি জেহাদ বিপন্ন করে তুলেছে আমাদের জীবন। লেখক, শিক্ষক, পুরোহিত, ব্লগার, খ্রিস্টান, শিয়া এবং আহমদিয়া কেউ বাদ যাচ্ছে না এই অন্ধকারের শক্তির খুনের নেশা থেকে। এরা একজনকে ধর্মের শত্রু বানিয়ে তাকে হত্যা করছে, করার চেষ্টা করছে, আবার সেই হত্যার পক্ষে সাফাই গাইছে তাদেরই মদদদাতা, যারা দিনভর উদার মতাদর্শের মানুষকে গালি দিচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। আমরা খুন হতে দেখেছি ধর্মপ্রাণ মানুষ, মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিমকে, এমনকি পীর-মুর্শিদদেরও।
হলি আর্টিজান হামলার পর পুলিশের সাফল্য জাতিকে আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু জাফর ইকবালের ঘটনার মাধ্যমে আবারও জঙ্গি আতঙ্ক গ্রাস করেছে আমাদের। নিষ্ঠুরতম পন্থায় মানুষ খুনের তালিম যে রাজনীতি থেকে তারা শিখেছে, তা এত সহজে বিলীন হওয়ার নয়। সামনে নির্বাচন, তাই আবার ভয়ংকর দুঃসময় দেশের জন্য।
একটা মতাদর্শের ভিত্তিতেই এসব করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। এমন এক বাস্তবতায় প্রশ্ন হলো, এই পাল্টা মতাদর্শ জাগিয়ে তোলার কোনো চেষ্টা আছে কি? প্রশ্নটা আজ এ কারণে উচ্চারিত যে, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তাঁর পরিবারসহ হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীতে। ১৯৯৬ পর্যন্ত যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কারিগর।
অতীত নিছক অতীত নয়, তার সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপটেই ভবিষ্যতের মুকুল। ১৯৭১ যেমন এক ইতিহাস, তেমনি ১৯৭৫-ও। আবার ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সময়টাও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে ২১ আগস্ট-এর মতো নিকৃষ্টতম হত্যাযজ্ঞ রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে হয়েছে, দেশের মানুষ উগ্র সাম্প্রদায়িকতার রূপ দেখেছে। বাংলাদেশের অতীত অসাম্প্রদায়িকতার, বহুত্ববাদের। নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের, নানা ধর্ম চর্চার। কিন্তু তবুও বারবার এখানে নানা কারণে উগ্রবাদী ধর্মীয় সংকীর্ণতা আমাদের আঘাত করেছে। আঘাত করে, কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলা শক্তিও সমঝোতা করে অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে।
যে বিরোধ চলছে, তা হিন্দু-মুসলিম, মুসলিম-বৌদ্ধ বিভেদ নয়। এই শক্তি একশ্রেণির লোক ভাড়া করছে, নিজেরাও সক্রিয় থাকছে উদারতার সঙ্গে, আলোকিত পথের সঙ্গে বিরোধ জিইয়ে রাখতে। পাকিস্তানি ধারা আর উগ্রতার ধারায় পরিচালিত অন্ধকারের শক্তি সমর্থন পায় রাজনৈতিক শক্তি থেকে যে রাজনীতির বিকাশ হয়েছে ১৯৭৫-এর পর থেকে।
আজ জাতির সামনে প্রশ্ন সে কি প্রগতি, শান্তি আর চিরায়ত ধর্মনিরপেক্ষতার ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে? উগ্রবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর লক্ষ্য এ দেশে কট্টর ছাড়া বাকিদের হত্যা করা। এই দৃষ্টিভঙ্গির গ্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করার লড়াই এখন সবার সামনে। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, ধর্মীয় হিংসা বরদাশত করা হবে না। গুরুত্বপূর্ণ তাঁর এ ঘোষণা। কিন্তু এখন শুধু বক্তৃতা নয়, শাসক দল এই ভাবনাকে কতটা বাস্তবায়িত করবে, সেটাই হচ্ছে বিচার্য বিষয়। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজটি করার যে লড়াই, সেখানে তারাই অগ্রবর্তী সৈনিক।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আজ বিশ্বব্যাপী আলোচিত। সেটিও একটি বড় কারণ। প্রগতি বিরোধী, উদারতাবিরোধী শক্তি উন্নয়নবিরোধীও। এই হত্যাকারীদের রোখা না গেলে উন্নয়নের গতি স্তব্ধ হতে বাধ্য। সুকৌশলে সে কাজটিই আসলে শুরু করেছে এই মহলটি।
সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলে টের পাওয়া যায় সন্ত্রাসী ও জঙ্গি মতাদর্শ কতটা বিস্তৃত। অনেক আলোচনাতেই দেখা যায়, উদারতার কথা বলা মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ভাবটা এমন যে যেন অন্য কোনো মতামত থাকা বা ইসলামের বাইরে অন্য ধর্মাবলম্বী হওয়াটা অপরাধ।
অন্তরের সম্পদই আসল সম্পদ, এ কথা বলার সময় এখন। বলতে হবে সবখানে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার কাজটা করতে হবে আমাদের। আর তার ভিত্তিটা হবে মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ ততক্ষণই সফল, যতক্ষণ না সে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে।
সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা বলেন এর গোড়ার কারণ খুঁজে বের করা কঠিন। যদি তাই হয়, তাহলে এই জঙ্গিবাদ বিনাশের আঁতুড়ঘর উপড়ে ফেলা হবে কেমন করে? গত দুই দশকে আকস্মিকভাবে ধর্মাশ্রয়ী মতাদর্শ, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনা বেশি গতিশীল হয়ে উঠেছে। আধুনিকতা যেমন বেড়েছে তথ্যপ্রযুক্তির কারণে, তেমনি বেড়েছে ধর্মীয় ভাবনা-চিন্তা। সেই ভাবনা-চিন্তাও আবার সনাতনী নয়, অনেকটাই বিদ্বেষমূলক, অন্য ধর্ম বা বিশ্বাসের প্রতি অনেক সহিংসতাপ্রবণ। ধর্ম আর সন্ত্রাসের এমন যোগসাজশ হঠাৎ করেই বদলে দিয়েছে মানসিক ভাবনার জগৎটা। ধর্মের শান্তির বার্তা ছেড়ে সহিংস রূপটাই বড় হয়ে উঠছে কিছু দলের কাছে। এরা ধর্মকে সন্ত্রাস থেকে আলাদা করতে পারছে না। অনেক মানুষকেও সেই ভাবনাতেই নিয়ে গেছে। এদের মতো সন্ত্রাসী হয় না বা সেই কর্ম করে না। কিন্তু একটা শ্রেণি আছে, যারা মুখে মুখে শান্তির কথা বললেও এসব জঙ্গি কাজের পক্ষে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যুক্তি দাঁড় করাতে চেষ্টা করে বা পরোক্ষ সমর্থন জোগায়।
সাম্প্রদায়িক ঐক্যের যে আদর্শ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার, যে আদর্শ ১৯৭২ সালে গৃহীত জাতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান ভিত্তি, রাজনীতিতে ধর্মকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে সেই আদর্শ লঙ্ঘন করা হয়েছে, যেভাবে তাতে উগ্রবাদের জন্য জায়গা বেড়েছে চরমভাবে।
সাধারণ মানুষ হিংসাত্মক কাণ্ডকারখানা অত্যন্ত অপছন্দ করে। তাই জঙ্গিবাদের বিপক্ষে জনগণকে জাগ্রত করা কঠিন নয়। একদিকে কঠোর হওয়া প্রয়োজন এই খুনি আর অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ায়, অন্যদিকে উদ্যোগ নিতে হবে অন্য সবদিক থেকেও। ঘৃণা আর হত্যা যে আদর্শের মূল স্তম্ভ এবং সেটি যে ধর্ম নয়, সেকথা বলতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ধর্মীয় সভায়ও।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।