অভিমত
মাদকের ব্যাপকতা

ল্যাটিন আমেরিকার পর সবচেয়ে ভয়াবহ মাদক উৎপাদনকারী দুটি জনপদের একটি আফগানিস্তান, অন্যটি মিয়ানমার। মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশী, আফগানিস্তানও খুব দূরের নয়। এর বাইরে ভারতের সাথে আমাদের বিশাল সীমান্ত এবং ওপারে শত শত ফেন্সিডিলসহ নানা ধরনের মাদক উৎপাদনরকারী কারখানা থাকায় মাদকের বড় ঝুঁকিতে বাংলাদেশ।
কোনো কোনো জরিপে বলা হয়েছে, বর্তমান দেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ লাখ। কোনো কোনো সংস্থার মতে ৭০ লাখ। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। তবে আরো বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশ পাচার হচ্ছে।
তবে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত তা নিয়ে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। এদের মনে হতে পারে, সরকার এই সমস্যার সমাধানে আগ্রহী নয়। কিন্তু গত কয়দিন ধরেই হঠাৎ করেই সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এবং এ লেখা যখন লিখছি, তখন ছয়দিনে ২৮ জন মাদক ব্যবসায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। অনেকেই এই অভিযানেক স্বাগত জানিয়েছে। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রশ্ন তুলছে বিচারবহির্ভূত পদ্ধতি নিয়ে, কেউ বলছে ক্রসফায়ারই কি মাদক নির্মূলের ঠিক উপায়?
মাদক সেবীদের বড় অংশই তরুণ বয়সের। পড়তে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে তারা মাদক চক্রে। পুলিশ বলছে, এনজিওরা বলছে, ঢাকা শহরের একাধিক নামি স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা মাদক চক্রে জড়িয়ে পড়ছে। নেশার টাকা জোগাড়ে অপরাধেও পিছপা হচ্ছে না তারা। কিন্তু সমস্যা শুধু বড় শহর, বা নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, সারা দেশেই।
এ সব কথা মাথায় রেখেই এবারের মাদকবিরোধী যুদ্ধে নেমেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি এই যুদ্ধে জয়ী হবেনই। প্রধানমন্ত্রীর এই দৃঢ়চেতা প্রত্যয় আশাবাদী করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় সেই কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে।
নানা আমরা প্রতিবছর নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাদকবিরোধী সচেতনতা গড়ার চেষ্টা করে আসছি। আমাদের একটি অধিদপ্তর আছে, তারাও বিভিন্ন সময় উদ্যোগ আর উদ্যমের কথা শুনিয়ে থাকে। কিন্তু মাদক নির্মূল তো দূরের কথা, দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি। এদের পরিদর্শকরা বড় শহরের বার বা ক্লাবে হানা দিয়ে লাইনসেন্স কমিশনে যতটা আগ্রহী, মাদকের বিরুদ্ধে ততটা উদ্যমি কি না সে প্রশ্ন আছে। আর অন্য যারা বিভিন্ন আয়োজন করে তারাও কি পড়ুয়াদের ভাবনা শুনছে বা শুনতে চেয়েছে কখনো? শোভাযাত্রায় স্কুল-কলেজের পডুয়াদের নিয়ে আসা হয়। শোভাযাত্রায় পোস্টার, ব্যানার হাতে হাঁটা হয় রাজপথ। কিন্তু এমন হেঁটে পুরোপুরি সচেতন হওয়া সম্ভব নয়। তার বদলে মাদকের নেশা রুখতে নতুন প্রজন্ম কী ভাবছে তা বোঝা জরুরি। উঠতি বয়সীদের কথা শোনাটাই মাদক রোখার প্রথম ধাপ। উত্তর খোঁজা প্রয়োজন অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতার কারণ কী?
বহু ছেলেমেয়ে কৌতূহলের বশেই ভালোমন্দের বিচার না করে নেশার দিকে ঝোঁকে। তাই কৈশোরেই সচেতন হলে এরা বেশি বয়সেও মাদক থেকে দূরে থাকবে। এলাকাতেও মাদক ব্যবসা রুখতে পারবে।
সারা দেশে প্রায় ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা করে। আশির দশকে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেলে এ সমস্যা মোকাবিলায় মাদকের অপব্যবহার, পাচার রোধ ও ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতার বিকাশ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, ১৯৮৯ জারি করা হয়। অতঃপর ২ জানুয়ারি ১৯৯০ তারিখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ প্রণয়ন করা হয় এবং নারকটিকস অ্যান্ড লিকার পরিদপ্তরের স্থলে একই বছর তৎকালিন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অধীনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ তারিখ এ অধিদপ্তরকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করা হয় এবং সর্বশেষ এ অধিদপ্তরকে একই মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৯০ সালে আইন হয়েছে, সময় আনেক গড়িয়েছে, আইনটির সংস্কার প্রয়োজন, কিন্তু আজও তা হয়নি। অভিযোগ আছে, মাদক ব্যবসার সাথে মূলত প্রভাবশালীরা জড়িত। এদের মধ্যে যেমন আছে, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক শক্তি, আছে পুলিশের কোনো কোনো সদস্য এমনকি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কর্মীরাও। অভিযোগ আছে যে, মাদক সেবনকারীদের চিকিৎসার নামে গড়ে ওঠা কিছু মাদক নিরাময়কেন্দ্রেও চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য।
এমন এক বাস্তবতায় বলতেই হচ্ছে, দেশের প্রায় সবখানেই পরিস্থিতি ভয়াবহ। হাত বাড়ালেই মাদক। ঠিক এমসয় এই যুদ্ধ ঘোষণা, সরকার প্রধানের অঙ্গীকার একটি নতুন প্রেক্ষাপট রচনা করেছে। কোনো সমস্যা স্থায়ী রূপ ধারণ করলে তা যেন গা সওয়া ব্যাপারে পরিণত হয়। বাংলাদেশে মাদকাসক্তি তেমনই এক ভয়ংকর সমস্যা, যা সমাধানের তাগিদ খুব কমই দেখা গেছে। দেখা যাক এবারের উদ্যোগ কত দূর যায়।
মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাচালানকারীদের ধরতে হবে, শাস্তি দিতে হবে ঠিকই। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন মাদকদ্রব্য সহজলভ্য যেন না হয় সেই পথ বন্ধ করা। ইয়াবা ও ফেন্সিডিলসহ বেশিরভাগ মাদকদ্রব্য আসে বিদেশ থেকে অবৈধ পথে। আমাদের সীমান্ত দিয়ে কী করে এসব আসে সেই প্রশ্নের উত্তর জরুরী। সীমান্তপথে মাদক চোরাচালান ও দেশের ভেতরে মাদকদ্রব্যের কেনাবেচা অত্যন্ত কঠোর হাতে বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে বিজিবি, পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জবাবদিহি নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। কারণ, তাদের একাংশের সহযোগিতা ছাড়া এই মাত্রায় মাদকের ব্যবসা চলা সম্ভব নয়। মানুষ আরো দেখতে চায় যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে তাদের দল কী ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিতে যাচ্ছে।
মাদকাসক্তি দূর করার জন্য সামাজিক ও পারিবারিক প্রচেষ্টাও খুব জরুরি। প্রতিটি পরিবারের সন্তানদের দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন; খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্র? ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেই থাকবে। কারণ বেকারদের শেষ আশ্রয় হয় মাদক কিংবা সহিংস পথ।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা