অভিমত
মানুষের স্বপ্নের সঙ্গে রাষ্ট্রের ব্যবধান

আমরা জানি বিচার দুই প্রকার- ন্যায় এবং অন্যায়। এবং সভ্য সমাজ এও বলে যে, অভিযুক্ত মানেই অপরাধী নয়। চটজলদি ‘বিচার’ করে দেওয়ার তাগিদ ন্যায় বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি নয়।
এ সময়ের আলোড়ন তোলা ঘটনা টেকনাফে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সেখানকার পৌর কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. একরামুল হকের নিহত হওয়া নয়, বরং মৃত্যুর সময়কালে রেকর্ড হয়ে যাওয়া অডিওই বেশি আলোচিত। ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যার মুহূর্তে প্রিয় সন্তান আর স্ত্রীর সাথে একরামের কথোপকথনের রেকর্ড প্রকাশ হওয়ার পর পুরো জাতি বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারের টেকনাফে গত ২৬ মে একরামুল নিহত হন। তাঁকে বাসা থেকে র্যাব এবং ডিজিএফআইয়ের স্থানীয় দুজন কর্মকর্তা ডেকে নেওয়ার পর হত্যা করা হয়েছে বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে।
এই মাদকবিরোধী অভিয়ানটি হঠাৎ করেই শুরু হয় এবং মাদক নির্মূলের পন্থা হয়ে দাঁড়ায় তথাকথিত বন্ধুকযুদ্ধ। শুরু থেকেই মানবাধিকারকর্মীরা এর বিরোধিতা করছিলেন। তবে সরকার এবং তার বাহিনীগুলো অনড় ছিল তাদের সিদ্ধান্তে। একরামের খুনের পূর্ব মুহূর্তের অডিও পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং বৈদ্যুতিক মাধ্যমে প্রত্যাশা মাফিকই আলোড়ন তৈরি হয়। এবং যা সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি, তাও এবার দেখা গেল। ১০ জন সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী বন্দুকযুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন গত শনিবার রাতে। আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে পরিচিত ১০ জন লেখক, কবি এবং শিল্পী চলমান মাদকবিরোধী অভিযান সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে অবিলম্বে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, এই অভিযানে প্রতিদিন অনেক মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। যা পুলিশ বন্দুক যুদ্ধে নিহত বলে বর্ণনা করছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থায় এমন মৃত্যু কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
এখন আমরা অপেক্ষায় আছি বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ হয় কি না, একরামের ঘটনার পেছনে যারা দায়ী তারা শাস্তি পায় কি না। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের পর শেখ হাসিনার সরকারকে আরো একবার বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে একরাম নিহত হওয়ার ঘটনা। এই ঘটনা কোনো কোনো বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত চুক্তিভিত্তিক হত্যার বিষয়টিকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে।
প্রায় সবাই এই ঘটনায় মর্মাহত হয়ে নানা কথা বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, একরাম অনেক আগেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর শিকার হয়েছিলেন। একটি চ্যানেলও এক সময় একরামকে মাদক কারবারি হিসেবে পরিচয় দিয়ে সংবাদ প্রচার করেছিল যার গ্রাফিক্স এখন ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে। সেই রিপোর্টে কী ছিল তা দেখা যায়নি। কিন্তু ফেসবুকে আসা ছবিতে দেখা যাচ্ছে তার ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বেশ ভালো পরিমাণ সম্পত্তি আছে। কিন্তু এখন এলাকার মানুষজন বলছে একরাম মাদক কারবারি ছিলেন না, বরং মাদকবিরোধী ছিলেন। তার আসলে তেমন কিছু নেই, অর্থাভাবে বাড়িটি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি এবং দুই কন্যাকে ভালো স্কুলেও পড়াতে পারেননি। যদি তাই হয়, তবে সেই গণমাধ্যমকেই এই তথ্য প্রমাণ করতে হবে। তবে এই ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে, অনেকের সম্পর্কেই যেসব তথ্য নানা সময়ে এসেছে সেসব হয়তো সত্য নয় এবং এমন ভুল তথ্যের ভিত্তিতে যদি তালিকা হয়, তবে তাতে বড় বিপর্যয় হওয়া স্বাভাবিক।
মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের এক অন্তহীন চক্রে আমরা জড়িয়ে পড়ছি কি না সেটাও ভাবনার বিষয়। একটি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, তা কিসের ওপর নির্ভর করে? সোজা কথায় সামাজিক নিয়ম এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর। নিয়মাবলি যদি যথাযথ হয়, প্রতিষ্ঠানসমূহ যদি উপযুক্ত হয়, তবে সমাজ ন্যায়সম্মত পথে চলবে। পুলিশ, র্যাব ইত্যাদি বাহিনীগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল নিয়ম মেনে চললেই ভরসা করা যাবে না যে, তারা ঠিক পথে আছে। এরা বাস্তবিক কী রূপ আচরণ করছে তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বা যাদের ওপর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আরোপিত হয়, তাদের নৈতিকতা কি কেবল যথাযথ নিয়ম এবং প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিশ্চিত করা যেতে পারে? একরামের বিষয়ে যদি মিডিয়ার তথ্য ভুল হয়, তবে আইনশৃংখলা বাহিনীর মতো গণমাধ্যমেরও সদাচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
সারা দেশে মাদকের বিস্তার ঘটেছে। হাত বাড়ালেই সব পাওয়া যাচ্ছে। অনেকের বিরুদ্ধেই নানা অভিযোগ। জেলায়, জেলায় প্রতিষ্ঠিত মাদক কারবারীরা তো আছেই, মাদক বাণিজ্য করার অভিযোগ আছে জনপ্রতিনিধি, আইনশৃংখলা বাহিনী ও মাদক নিয়স্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মীদের বিরুদ্ধেও। আইনের দৃষ্টিতে অভিযুক্ত কোনো একজন ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা দোষী নন। এটাই ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্ন।
মাদক কারবারি হিসেবে কেউ যদি বন্ধুকযুদ্ধে মারা যায়, তার পরিবার একদিকে একজন স্বজন হারায়, যা কিছু দিয়ে পূরণ করা যায় না। যেই হোক, যেমনই হোক, একজন মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু অন্য একটি হলো নৈতিকতার সম্মান। পরিবারটির সদস্যরা কোনো কিছুর সাথে না জড়িয়েই হয় তো আজীবন এমন একটি অসম্মান নিয়ে জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবে।
একরামের মৃত্যু প্রমাণ করে, ক্ষমতার অলিন্দে থাকা কুশলী খেলোয়াড়রা নিজেরা বাঁচতে অনেককেই ফাঁসিয়ে দিয়েছে বা দিচ্ছে। দেশজুড়ে আওয়াজ উঠছে অভিযানের স্বচ্ছতা নিয়ে। এর কোনো বিকল্প নেই। শুধু রাষ্ট্র নয়, প্রতিটি সমাজ-সংগঠনের, মিডিয়ার কাছ থেকেও এই স্বচ্ছতা প্রত্যাশিত। প্রয়োজন বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের, যাতে দ্রুত এবং স্বল্পতর খরচে ন্যায় বিচার পাওয়া যেতে পারে, তবেই বন্দুকযুদ্ধের মতো ভয়াবহ সংস্কৃতির অবসান ঘটবে। পুলিশি ব্যবস্থাকে মানবিক, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ করে তোলার দাবিটিও একই সাথে উচ্চারিত। এসব না হলে, ক্ষমতা মুষ্টিমেয়র হাতে সংহত হয় এবং রাষ্ট্র ক্রমাগত সেই ক্ষুদ্র ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার এক যন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। জনসাধারণের ইচ্ছা এবং স্বপ্নের সঙ্গে রাষ্ট্রের ব্যবধান প্রান্তর প্রান্তর হয়।
লেখক : এডিটর ইন চিফ, জিটিভি ও সারাবাংলা