অভিমত
শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/05/15/photo-1463311148.jpg)
ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষা-সংস্কার’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে টলস্টয়ের একটি দীর্ঘ উক্তি ইংরেজিতে উদ্ধৃত করেছিলেন। হয়তো স্বদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন, টলস্টয়ের উক্তি উদ্ধৃত করে তা বলা তাঁর পক্ষে সুবিধাজনক ছিল। উদ্ধৃতির একটি অংশ বাংলায় অনুবাদ করলে এই দাঁড়ায় :
‘জনসাধারণের অজ্ঞতাই সরকারের শক্তির ভিত্তি। সরকার এটা জানে। এ জন্য সব সময়ই সরকার প্রকৃত জ্ঞান বিস্তারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে। এ সত্য এখন আমরা উপলব্ধি করেছি। সরকার কাজ করে যাচ্ছে জনসাধারণকে অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখার জন্য। এ অবস্থায় সরকার দেশে জ্ঞান বিস্তারের যে ভান করে চলছে, কোনো ক্রমেই তাকে চলতে দেওয়া যায় না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, একাডেমি, নানা ধরনের অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখার কাজই করছে। ভালো তখনই ভালো, যখন তা প্রকৃতপক্ষেই ভালো এবং জ্ঞানও তখনই জ্ঞান, যখন তা প্রকৃতপক্ষেই জ্ঞান। যখন দেখি, অনুপ্রাণিত নিষ্কাম লোকদের প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন গভীর দুঃখ অনুভব করি। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি যে, মহৎপ্রাণ জ্ঞানী লোকেরা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শক্তি ক্ষয় করেন কিন্তু সংগ্রামে তাঁদের শক্তি অপচিত হয় মাত্র এবং তাঁদের প্রয়াস শেষ পর্যন্ত সরকার যা করতে চায় তারই অনুকূলে যায়।’
টলস্টয় আরো লিখেছেন,
‘যে অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা চলছি, তাতে মনে হয়, ঠিক কাজটি নীরবে ধৈর্যের সঙ্গে করে যাওয়াই আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। আমরা যা করতে চাই, তাতে সরকারের অনুমোদন পাওয়ার কোনো দরকার নেই। কেবল সরকারের অনুমোদন পরিহার করাই যথেষ্ট নয়, আমাদের কাজ করতে হবে সরকারের সাহায্য-সহযোগিতাও পরিহার করে।’
কথাগুলো টলস্টয় বলেছেন তাঁর সমকালীন রাশিয়ার অবস্থা লক্ষ করে। সরকারকে সর্বতোভাবে পরিহার করে শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করার কিছু সুযোগ হয়তো সেদিনের রাশিয়ায় ছিল। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে সে রকম সুযোগ কি আছে? সরকারি সার্টিফিকেট লাভের সুযোগ না থাকলে প্রতিষ্ঠানে কে পড়তে আসবে? আর সে রকম আয়োজনে কে কতদিন পড়াতে আগ্রহ বোধ করবে?
সরকারের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা স্পষ্ট যে পর্যবেক্ষণ টলস্টয় ব্যক্ত করেছেন, তা বোধ হয় সব রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কেই ঠিক। বিষয়টিকে নানাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। সরকার নিজের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা নিশ্চিত রাখার কথা আগে চিন্তা করে- তারপর চিন্তা করে জনসাধারণকে শিক্ষা ও জ্ঞান দানের কথা। এসব নিয়ে যত অনুসন্ধান করা হবে এবং বিচার-বিবেচনা করা হবে, টলস্টয়ের উক্তির সত্যতা ততই প্রকটিত হবে।
বাংলাদেশে পঞ্চম শ্রেণিতে ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা কেন প্রবর্তন করা হয়েছে? কোনো শিক্ষক, কোনো ছাত্র, কোনো অভিভাবক, কোনো লেখক, কোনো সাংবাদিক, কোনো রাজনৈতিক নেতা কি চেয়েছেন এটা? শিক্ষার্থীর সামাজিক যোগ্যতার প্রমাণ নেওয়ার জন্য পরীক্ষায় অপরিহার্যতা আছে। কিন্তু জ্ঞান লাভের জন্য পরীক্ষা প্রায়ই সহায়ক নয়। অথচ বাংলাদেশের গোটা শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে করে তোলা হয়েছে সম্পূর্ণ পরীক্ষামুখী। এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা প্রবর্তনের ফলে কোচিং সেন্টার, গাইড বুক ইত্যাদির ব্যবসায়ে স্বর্ণযুগ দেখা দিয়েছে। শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে না অবনতি হচ্ছে?
সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির নামে যে পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, তা দ্বারা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিমুখ, জ্ঞানবিমুখ পাঠবিমুখ করে তোলা হচ্ছে। কে চেয়েছেন এই পরীক্ষা পদ্ধতি? শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, লেখক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা কে? ক্রমাগত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলন দেখা দেয়। প্রতিকার হয় না।
বাংলাদেশের বহুধাবিভক্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার যে ধারায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড পাঠ্যপুস্তকের জোগান দেয়, তা মূলধারার শিক্ষা বলে অভিহিত। এটা বাংলা মাধ্যমে চলত। এখন এ ধারাকে দুই শাখায় বিভক্ত করে ইংলিশ ভার্সন নামে নতুন শাখা চালু করা হয়েছে। সরকার ঘোষণা না দিয়ে এ ধারায় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ধারার শিক্ষাকে যে কোনো উন্নত রূপ ও প্রকৃতি দেওয়া হচ্ছে, তার কোনো লক্ষণই আমরা খুঁজে পাই না। সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণের জন্য বিশেষ তৎপর। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ইংলিশ মিডিয়ামে পরিচালিত ‘ও’ লেভেল ‘এ’ লেভেল বাংলাদেশে ভালো ভাবেই চলছে। তার ওপর প্রবর্তন করা হয়েছে ইংলিশ ভার্সন। অবহেলিত হয়ে চলছে মূলধারার বাংলা মাধ্যমের শাখা। সরকার শিক্ষা, জাতি ও রাষ্ট্র নিয়ে কী চায় বোঝা যায় না। জাতীয় জীবনে কাজকর্মের মধ্যে সরকারের চরিত্র-রাজনৈতিক চরিত্র-তলিয়ে দেখা একান্ত দরকার।
সরকার দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে : ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, খ্রিস্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা। গণতন্ত্র ও নৈতিক শিক্ষা, সমাজতন্ত্র ও নৈতিক শিক্ষা, জাতীয়তাবাদ ও নৈতিক শিক্ষা নেই। গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদীদের নৈতিক মান কি স্বতঃস্ফূর্তভাবে উন্নত থাকে? দুর্নীতির অভিযোগ কাদের বিরুদ্ধে বেশি- তারা কি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী, জাতীয়তাবাদী? ধর্মনির্ভর নৈতিক শিক্ষা যেভাবে দেওয়া হচ্ছে তা কি জাতীয় ঐক্যের অনুকূল? জাতীয় ঐক্যের কি কোনো দরকার নেই? জাতীয় ঐক্য ছাড়া রাষ্ট্র হয়? নিজেদের রাষ্ট্র কি আমরা রাখতে চাই না?
বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। পর্যায়ক্রমে করতে হবে। টলস্টয়ের পর্যবেক্ষণ অবশ্যই মনে রাখতে হবে। তারপরও সংস্কারের জন্য কাজ করতে হবে। সারা দেশের বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিরা যদি ন্যায়-নিষ্ঠার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে কাজ করেন, তাহলে জনজীবনে তার সুফল দেখা দেবে। সরকার উল্টো পথে থাকতে পারবে না। কয়েকটি বিষয় নিয়ে এখন বৌদ্ধিক আন্দোলন চালানো দরকার। রাতারাতি কিছু করা যাবে না। দরকার দূরদর্শিতা ও সুদূরপ্রসারী কর্মসূচি। নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিয়ে আন্দোলন চালানো দরকার :
১. পঞ্চম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ করা হোক। শিক্ষাপদ্ধতি উন্নত করা হোক।
২. কথিত সৃজনশীল পরীক্ষা-পদ্ধতি বাতিল করে শিক্ষা-সহায়ক উন্নত পরীক্ষা-পদ্ধতি চালু করা হোক। শিক্ষাকে পরীক্ষামুখী না রেখে জ্ঞানমুখী করা হোক।
৩. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের মূলধারার বাংলা মাধ্যমের শাখায় যথোচিত গুরুত্ব দেওয়া হোক। ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক ও সরকার সবাইকেই এ ব্যাপারে মনোযোগী করে তোলার জন্য এবং বৃহত্তর শিক্ষিত সমাজে এ বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের কর্মতৎপর হতে হবে।
৪. সব শিক্ষার্থীর নৈতিক সচেতনতা ও নৈতিক মান উন্নত করার জন্য ‘নীতিবিদ্যা ও নীতিশিক্ষা’ নামে একটি বিষয় চতুর্থ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বিষয়রূপে চালু করা হোক। ধর্মশিক্ষা অব্যাহত রাখা হোক।
৫. পাঠ্যসূচি ও পাঠক্রমকে দেশ-কাল উপযোগী করে পাঠ্যপুস্তক উন্নত করা হোক। বিশ্বায়নের সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিহার করে পাঠ্যসূচি ও পাঠক্রমকে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হোক। চাকমা, গারো, সাঁওতাল প্রভৃতি জনগোষ্ঠী যাতে মানবজাতির মূলধারায় এগিয়ে আসতে আগ্রহী হয়, সে জন্য তাদের শিক্ষার উন্নতিতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
৬. প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, কৃষি, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে ‘সভ্যতার পরিচয়’ এবং ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ চালু করা হোক।
৭. উচ্চশিক্ষায় এবং প্রকৌশল, কৃষি, চিকিৎসা, বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি গ্রহণ করা হোক এবং বিশ্বায়নের নামে পরিচালিত সাম্রাজ্যবাদের ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি’ পরিহার করা হোক।
এই বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষা আন্দোলন চালানো হলে সরকার অবশ্যই নিজের স্বার্থেই এগুলো মেনে নেবে। জনজীবন, জাতি ও রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য আর্থসামাজিক, রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির বৃহত্তর কর্মসূচি নিয়েও কাজ করতে হবে। বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের অগ্রযাত্রীর ভূমিকা পালন করতে হবে। জনসাধারণকে খুঁজে বের করতে হবে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের। নিদ্রা ভেঙে জাগতে হবে। অবস্থা উন্নত করা যাবে।
লেখক : সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।